গ্লোবালের আড়ালে লোকাল ।। গৌতম চৌধুরী
কবিতাপাঠের রুচি যেন একপ্রকার নাছোড় ব্যাধি, যাহাদের আক্রমণ করে, সারা জিন্দেগির মতো তাহাদের ভোগাইয়া মারে। গল্প-উপন্যাস পাঠের মহৎ অভ্যাসটি, তুলনায়, আগ্রাসী জ্বরের মতো। কামড় বসাইলে রক্ষা নাই, কিছুদিনের জন্য ভিতর-বাহির তোলপাড় করিয়া ছাড়ে। কিন্তু একবার ছাড়িয়া গেলে সহসা আর ফিরিয়া আসে না। প্রিয় পাঠিকা-পাঠকের নিকট পহেলাই একথা কবুল করিয়া নেওয়া ভালো যে, এ-ব্যাপারে বর্তমান কথকের অভিজ্ঞতা প্রকৃতই শোচনীয়। একুশ শতকে প্রকাশিত বিভাগোত্তর প্রজন্মের মাত্র দুইটি বাংলা উপন্যাস পাঠের সৌভাগ্য আমাদের ঘটিয়াছে- ১. নবারুণ ভট্টাচার্য কৃত কাঙাল মালসাট (২০০৩) এবং ২. সালমা বাণী রচিত ভাংগারি (২০০৪)। অতঃপর আরও নবীন কোনও লেখকের রচনার সহিত পরিচিত না হইতে পারিলে বাংলা উপন্যাসের হাল-হকিকত সম্পর্কে এক প্রকার ভাসা ভাসা জ্ঞান (পড়ুন, পুস্তক পর্যালোচনা পাঠ প্রসূত জ্ঞান) লইয়াই ভবলীলা সাঙ্গ হইবে, এইরূপ একটি হীনমন্যতায় ভুগিতেছিলাম। এমতাবস্থায় জনৈক বন্ধুর বদান্যতায় হাতে আসিয়া পঁহুছিল একেবারে তরুণ এক গদ্যকার মাহবুব মোর্শেদ (জন্ম ১৯৭৭) রচিত একটি উপন্যাস- ফেস বাই ফেস (প্রকাশ, একুশে বইমেলা ২০১০)।
জমাটি গল্পকারের একটি বহুপরীক্ষিত কৌশল হইল, মোক্ষম তাসটি আস্তিনের নিচে চুপচাপ চাপিয়া রাখিয়া একেবারে অন্তিম মুহূর্তে পাঠকের টেবিলে ঠকাস করিয়া ফেলিয়া দিয়া তাহাকে কুপোকাত করা। এ-ব্যাপারে গোয়েন্দা বা ভূতের গল্পের সাফল্য মনে হয় সব লোকপ্রিয় লেখককেই তাড়া করিয়া ফেরে। গল্প বলিবার অন্য কিছু তরিকাও অবশ্য লেখকদের নিকট হইতে আমরা পাইয়াছি। যেমন, ১) রহস্য যদি আদৌ কিছু থাকে, তাহা প্রথমেই ফাঁস করিয়া দিয়া পরে তাহা লইয়া প্যাচাল পাড়া (সাহিত্যের ভাষায়, রহস্যটি বিনির্মাণ করা)। ২) জীবনের কোথাও কোনও রহস্য যে নাই, রহস্যহীনতার সেই হাহাকার হইতে কথা বলা। ৩) কথা বলিতে বলিতে রহস্যকে আবিষ্কার করা, যেন পাঠক আর লেখক একইসাথে তাহার মুখোমুখি হইলেন, এইরূপ একটি আবহ সৃষ্টি করা ইত্যাদি। দেখা গেল, মাহবুব মোর্শেদ তাঁহার প্রথম উপন্যাস ফেস বাই ফেস-এ, পাঠককে চূড়ান্তে চমক দিবার সনাতন ধারাটিকেই বাছিয়া লইয়াছেন। তাঁহার আস্তিনে লুকানো সেই যাদু-তাসটি হইল, উপন্যাসের কথক-নায়ক শুভর অন্যতম ও প্রধানতম বান্ধবী তিন্নির সমকামিতা। গল্পের একেবারে শেষে পঁহুছিয়া যে-তথ্যটি উদ্ঘাটিত হওয়ার সাথে সাথে পাঠকের সুনিশ্চিত বিস্ময়ের সম্ভাবনায় লেখকের ঠোঁটের কোণে ফুটিয়া উঠা তৃপ্তির হাসিটিও আমরা পড়িয়া লইতে পারি, যাহার অর্থ হইতেছে, কী, কেমন দিলাম।
বছর পাঁচেক আগে একটি পশ্চিম-ইউরোপীয় ছবিতে (নাম মনে নাই) নারীর সমকামিতার এক আগ্রাসী ও মারমুখী মূর্তি দেখিয়াছিলাম, সঙ্গিনীর বিষমকামী হইয়া উঠিবার সামান্য সম্ভাবনা দেখা দিলে আদিম ঈর্ষাবশে যে-প্রেম রক্তারক্তি, খুনোখুনি অবধি গড়াইয়াছিল। সম্পূর্ণ ভিন্ন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত হইতে উঠিয়া আসা এক বাঙালি মেয়ে বলিয়াই এ-উপন্যাসের তিন্নি সেসব অতিরেকের ধারকাছ দিয়াও যায় নাই। না যাইবারই কথা। সে শুধু তাহার সঙ্গিনী সুপর্ণার বিবাহের সম্ভাবনা একবার ভাঙিয়া দিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছে। কিন্তু তাহা যে স্রেফ একটি কুচুটেপনা মাত্র ছিল না, সে-বিষয়ে লেখক আমাদের পুরোপুরি নিঃসংশয় করিয়া তুলিতে পারেন না। কারণ, সুপর্ণার বিবাহসম্ভাবনাটি সে-যাত্রা ঘনাইয়া উঠিয়াছিল শুভ’র সহিত, যে-শুভ আসলে তিন্নিকেই কলেজজীবন হইতে ভালোবাসিয়া আসিয়াছে, কিন্তু বহু বছরের প্রতীক্ষাতেও কোনও ইতিবাচক সাড়া না পাইয়া শেষমেশ সুপর্ণার দিকে আগাইয়াছে ও জড়াইয়া গিয়াছে। তাই এ-ধন্দ থাকিয়াই যায়, অমন বিবাহটি তিন্নি ভাঙিল কেন, নিছক সুপর্ণার প্রতি আসক্তিবশত? তাহা হইলে অল্পকিছুদিন বাদেই যখন পারিবারিকভাবে পুনরায় তাহার বিবাহ ঠিক হইল, তিন্নি তো তখন কোনওরূপ বাধা দিল না! বরং সে সেই বিবাহবাসরের নিমন্ত্রণও গ্রহণ করিল। তাহা হইলে কি শুভকে অবিবাহিত রাখিয়া দিয়া, তাহার দুর্বলতার সুযোগ লইয়া তাহার উপর কর্তৃত্ব ফলানোর রাস্তাটাও তিন্নি খোলা রাখিতে চাহে নাই?
আসলে তিন্নির সমকামিতার আখ্যানটাই একটু নড়বড়ে, যেহেতু তাহা দাঁড়াইয়া আছে লেখকের ঐ একটি মাত্র যাদু-তাসের উপর। উপন্যাসের শেষে তিন্নির ফ্যাঁচফ্যাঁচে কাঁদুনির মৌখিক বয়ানের উপরে ভরসা করিয়াই আমাদের ব্যাপারটি গিলিতে হয়। প্রসঙ্গের কোনও পূর্বপ্রস্তুতি না রাখিয়া লেখক চমক দিতে চাহিয়াছেন, ভালো। কিন্তু প্রবণতার দিক হইতে চরিত্রটি যখন এক সংখ্যালঘু মানসের অধিকারী, তখন, অন্তত রহস্যটি ফাঁস হওয়ার পর, তাহার সেই মানস-জটিলতার স্তরপরম্পরাগুলি পাঠকের কাছে আরও বিশদ হইবার অবকাশ থাকিয়াই যায়। যেমন একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসাবে সুপর্ণা ও তাহার পারিবারিক পটভূমির বিশ্বাসযোগ্য রূপায়ণের একটা আলাদা চেষ্টা লইয়াছেন লেখক। তিন্নি চরিত্রের সেই অনুসন্ধানী বিশ্লেষণের অভাবে পাঠকের মনে কতকগুলি প্রশ্ন জাগে। সুপর্ণা যেহেতু যুগপৎ তিন্নির সমকামী সঙ্গিনী এবং শুভ’র প্রেমিকা, তাহাকে আমরা এক উভকামী নারী বলিয়াই ধরিয়া লইতে পারি। অন্যদিকে, তিন্নি যদি নিরঙ্কুশ সমকামী, তাহা হইলে সুপর্ণার বিচ্ছেদে হয় সে বিরহ উদ্যাপন করিবে, নচেৎ কোনও পুরুষ নহে, অন্য কোনও নারীরই প্রতি ধাবিত হইবে। কিন্তু যেভাবে সে শেষ পর্যন্ত শুভকে মানিয়া লয়, তাহাতে তাহার এক উভকামী সত্তার পরিচয়ই জাগিয়া উঠে। ইহা কি তাহার ভিতরে একটি নূতন উপলব্ধি? যদি তাহাই হয়, সেই মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার কোনও পরিচয় লেখক আমাদের দেন নাই। আর সে যদি প্রথমাবধিই উভকামী ছিল, তাহা হইলে শুভ আর সুপর্ণা দুইজনের সহিতই সম্পর্ক বহাল রাখিয়া, গল্পকে একটা অন্যতর মাত্রায় লইয়া যাইতে পারিত। কাজেই তিন্নির সমকামিতাটা শেষ পর্যন্ত একটা পড়িয়া পাওয়া চৌদ্দ আনা স্টান্ট হইয়াই থাকিয়া যায়।
২
উপন্যাসটির উৎসর্গপত্রে উৎকলিত কবি উৎপলকুমার বসুর পঙ্ক্তিগুলি বলিতেছে-
‘তোমাদের মজার এক গল্প বলি শোনো’ কে যেন বলল ডেকে,
কোন গল্প, কাকে নিয়ে, সমস্ত ভুলেছি। শুধু শালবনে- দূরে-
জলার মতন এক স্বচ্ছ জল অন্তিম গোধূলি নিয়ে
আলো হয়ে ছিল
তথাপি, শেষ পর্যন্ত মাহবুব মোর্শেদ যে আমাদের কোনও অন্তিম গোধূলি আলোর মুখোমুখি দাঁড় করান না, তাহার জন্য পাঠক হিসাবে তো কিছুটা প্রতারিত বোধ করিবারই কথা। কিন্তু সেটা ঘটে না, মুখ্যত লেখকের উপাদেয় লিখনভঙ্গিমা আর একাধিক বিশ্বাসযোগ্য চরিত্রের সফল উপস্থাপনার কারণে। সুনীল বা হুমায়ূনের রচনায় যে একধরনের সাবলীল সুখপাঠ্যতা থাকে, লেখক অনায়াসে সে-সাফল্য স্পর্শ করিয়াছেন। তিনি যদি শুধু এইটুকুই চাহিয়া থাকেন, তাহা হইলে অচিরেই বাংলাবাজারে আরও একজন বেস্ট সেলার লেখকের অভিষেক ঘটিতে চলিয়াছে, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তবে বাণিজ্যসফলতাই যে এ-লেখকের একমাত্র কাক্সিক্ষত নিয়তি নয়, তাহারও ঢের পরিচয় বর্তমান উপন্যাসটির পাতায় পাতায় ছড়ানো রহিয়াছে। যেকোনও স্বপ্নদর্শী তরুণের মতোই, জীবনের প্রথম উপন্যাসের করণকারিত্বে কিছু একটা অভিনবত্ব আমদানি করার কথা ভাবিয়াছেন তিনি। আর তাহা করিতে গিয়া, তৃতীয় বিশ্বের সমাজবাস্তবতার গহন ঘূর্ণিপাকে ডুব দিয়া নাকানিচুবানি খাওয়ার বদলে, তিনি বাছিয়া লইয়াছেন পৃথিবীর নানাপ্রান্তে গহন দ্বীপের মতো ছড়ানো কিছু মানবহৃদয়। সেইসব ছিন্নবিচ্ছিন্ন হৃদয়ের ঐক্যের পটভূমি হইল তাহাদের এক হইতে বহুতে পৌঁছানোর আকাক্সক্ষা, আর সেই দূরসঞ্চারের অবলম্বন হইল আন্তর্জাল।
আখ্যানের কথক শুভ যেহেতু কর্মসূত্রে আন্তর্জালের ব্যবহারকারী, অবসরের মন্থরতা কাটাইতে সে প্রায়শই ঢুকিয়া পড়ে বদনবই (ফেসবুক) নামের সামাজিক জালবুনটের জগতে। তাহার ল্যাপটপের পর্দায় জাগিয়া উঠে একের পর এক নানা দূরাগত অভিব্যক্তি। এইসব ধারাবাহিক মুখচ্ছবির ব্যঞ্জনা হইতেই উপন্যাসটির নাম হইয়া উঠে ফেস বাই ফেস। যেখানে একের পর এক নানা বয়সের নানা বাঙালি নারীপুরুষ কথা বলিয়া উঠে হরফের ভাষায়। মুছিয়া যায় শারীরিক ব্যবধান, কখনও কখনও যে-দূরত্ব হয়তো ভূগোলের মাপে কয়েক হাজার কি.মি.। এই উপন্যাসে মাহবুব মোর্শেদের সর্বাপেক্ষা বড় কৃতিত্ব হইল এই ভার্চুয়াল চরিত্রগুলির সৃষ্টি। নাজিয়া, সাবিনা মেহনাজ, শেরি, মারিয়া, মাধবীÑ প্রতিটি চরিত্র এত আলাদা, অথচ প্রতিটিই এমন বিশ্বাসযোগ্য হইয়া উঠিয়াছে যে, লেখকের সহিত আমরাও চরিত্রগুলির শ্বাসপ্রশ্বাস অনুভব করি।
কিন্তু লেখক বিলক্ষণ জানেন, নিছক চমকপ্রদ কিছু চরিত্র সৃষ্টি করিয়া ফেলিলেই পাঠকের মন পাওয়া যাইবে এমন নহে। তাহার জন্য গপ্পো ফাঁদিতে হইবে। লেখক কাজেই দুই নৌকায় পা দিয়াছেন, যদিও যেকোনও সৃজনশীল মানুষের মতোই সে-অধিকার তাঁহার আলবাত আছে। তিনি শুধু অথই দরিয়া হইতে জালে তোলা মাছেই খুশি থাকেন নাই, পোক্ত হাতে হুইল-বঁড়শি দিয়া কাছাকাছি ঝিল-নালা-পুকুরের মাছ তুলিতেও কসুর করেন নাই। গ্লোবালের মোড়কের আড়ালে তাঁহার গল্প আসলে এইসব লোকালদের লইয়াই দিব্য আড়ে-বহরে খেলিয়া গিয়াছে। এইসব স্থানীয় চরিত্রগুলির জন্য বদনবইয়ের অবতারণা অবশ্য একটি বাহানা মাত্র। তাহাদের লইয়া গল্প যেভাবে আগাইয়াছে, সেখানে বদনবই না থাকিলেও এমন কিছু আসিয়া যাইত না। তবে থাকাতেও অসুবিধা কিছু হয় নাই, মাঝে মাঝে বরং বৈচিত্র্যও তৈরি হইয়াছে। যেমন নওরোজ ভাইয়ের তারুণ্যে উদ্দীপ্ত চরিত্রটি। পরার্থপর ও শুভমঙ্গলবাদী জীবন সাহাও এক চমৎকার সৃষ্টি। সমকামিতাটা তাহার জন্য যতই আলংকারিক মনে হউক, তিন্নি কিন্তু পাঠকের মন কাড়িয়া লয়। শুভকে কেন্দ্র করিয়া তাহার স্ববিরোধী ও প্রাণচঞ্চল চরিত্রটির উন্মোচন খুবই বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপিত হইয়াছে। তুলনায় সুপর্ণার চরিত্রায়ন একটু আড়ষ্ট। তাহার ও শুভর আপাতকাব্যিকতাময় যৌথদৃশ্যগুলি কথঞ্চিৎ সু.গ-মার্কা। কিন্তু চিরকিশোর পাঠকদের জন্য বাণিজ্যসাহিত্যের নির্মাতা প্রাগুক্ত লেখকের কাঁচা ও জোলো রোমান্টিকতা (পড়ুন, শারীরিকতা) বড় বেশি ছায়া ফেলিয়াছে রওনক ভাবীর সহিত শুভর ডেটিংয়ের দিনটিতে। অন্যথায় ভাবীর চরিত্রটি কিন্তু নওরোজ ভাইয়ের পরিপূরক হিসাবে ভালোই জমিয়াছিল।
ফয়সল ভাইয়ের চরিত্রটি এ-উপাখ্যানে সম্পূর্ণ অনাবশ্যকভাবে আসিয়া গিয়াছে বলিয়া মনে হয়। যেন ২৫ গ্রাম জ্যোতিষ আর ৫০ গ্রাম পানশালা-দৃশ্যের অবতারণা করিবার জন্যই তাহার সৃষ্টি। তাহাকে বানাইয়া বলা স-সুপর্ণা-শুভ’র রাজস্থান ভ্রমণবৃত্তান্তটিও হইয়া উঠিয়াছে যাদুবাস্তবতা সৃষ্টির একটি ব্যর্থ প্রয়াস। সহস্রযোজন দূরের নায়াগ্রাপ্রপাতের জলধ্বনিও যেখানে বিশ্বাসযোগ্যভাবে অনুরণিত হইতে পারিল, রাজস্থানের মরু পাঠকদের কেন প্রতারিত করিল কে জানে! হয়তো বানাইয়া বলিতেছেন বলিয়া লেখক এরূপ সচেতন ছিলেন যে, প্রাণপ্রতিষ্ঠা হইল না। নায়াগ্রা ও পিংক সিটির অভিজ্ঞতা বর্ণনার সামান্য কিছুটা করিয়া অংশ পাশাপাশি পাঠ করিলেই ইহাদের শিল্পমাত্রার তারতম্য আমাদের চোখে ধরা পড়ে-
টানেল ধরে যখন জলপ্রপাতের একদিক থেকে অন্যদিকে যাচ্ছিলাম মনে হচ্ছিল প্রচণ্ড গর্জনের ভেতর হারিয়ে গিয়েছি। হয়তো এ রকম প্রচণ্ড বা এর চেয়ে তীব্র কোনো গর্জনের ভেতর ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। শব্দের প্রচণ্ডত্বের মধ্যেও মানুষ যে হারিয়ে যেতে পারে নায়াগ্রা না গেলে বুঝতাম না। (পৃ.২৩) [ভাষা প্রাণবন্ত এবং কবিতামণ্ডিত]
চাঁদ তখন মাঝ আকাশে। পূর্ণ আলো ফেলেছে শহরের খোলা স্থানে। তার বিভা মরুর বুকে একটা গোলাপি ফুল ফুটিয়ে দিয়েছে। ছোট ঘরগুলো সেই গোলাপি ফুলের এক একটি পাপড়ি। তখন পুরো শহর ঘুমিয়ে পড়েছে। নৃত্যলহরীর সঙ্গে আসা গান থেমে গেছে। ছোট নির্জন ছাদে আমি আর সুপর্ণা। (পৃ. ৮৬) [ভাষা অসংহত ও কাব্যিকতাপ্রয়াসী]
এ-উপন্যাসের ভাষার সাবলীলতার উল্লেখ আমরা ইতোমধ্যেই করিয়াছি। পরিবেশ প্রতিষ্ঠার দক্ষতায় মাহবুব প্রায়শই সেই প্রাথমিক সাফল্যকে টপকাইয়া যে-শিল্পিত আবহের সৃষ্টি করেন, তাহার দু’একটি নমুনায় একবার চোখ বুলাইয়া লইতে পারি-
১. তার মাঝে মাঝে মনে হতো, কুইবেকে সেই একলা বাড়িতে গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসবে। চারদিকে সার সার বার্চ গাছ। তুষার জমে পার্কের জমিন শাদা হয়ে আছে। তীব্র কুয়াশার মধ্যে যেখানে মারিয়া হেঁটে হেঁটে উজ্জ্বল আলো ভরা স্টোরে চলে যায়। (পৃ. ৬৯)
২. তখন বর্ষাকাল, আকাশে মেঘ কিন্তু দূরে দূরে। পাকশী আসার আগেই ট্রেনলাইনের দুপাশের সবুজ ঘন গাছপালার প্রেমে পড়ে যাচ্ছিলাম। দূরের বাজার, কাছের মানুষ, খুব ভালো লাগছিল। ট্রেন ব্রিজের ওপর উঠার আগেই দেখলাম এক অপূর্ব জলমণ্ডল। সন্ধ্যার আলো তখনও মেলায়নি। নীল জলে একটু একটু একটু শাদা-কালো মেঘের স্পষ্ট প্রতিবিম্ব। (পৃ. ৭১)
৩. ক্ষেতের ধারে শর্ষের ঝাঁঝালো গন্ধ নেয়ার পর দূরের গ্রাম লক্ষ্য করে আবার হাঁটতে থাকি। শাদা মূলার ফুল ফুটে আছে। তারও অন্যরকম ঝাঁঝালো গন্ধ। মটরশুঁটি। ডাঁটা শাক, লাল শাক, করলার ক্ষেতের আল ধরে ধরে একটা গ্রামে পৌঁছাই। কয়েকটা বাড়ি। কয়েকটা তালগাছ। একটা ছোট টংয়ের দোকান। (পৃ. ১০৭)
প্রকৃতিবর্ণনার এই বহুবিধ পাঁয়তারা (শব্দটি এখানে প্রশংসার্থে ব্যবহৃত হইল) ছাড়াও বহু গভীর দার্শনিক উপলব্ধি, চমকপ্রদ উক্তি, ফাজলামি, কৌতুক ইত্যাদি উপন্যাসটির পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ছড়াইয়া আছে।
১. নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় নাকি ঐতিহাসিক স্থান দেখার মতো অনুভূতি তৈরি করে।
২. স্মৃতিচারণ খুব খারাপ জিনিস। স্মৃতি অতীতের কদর্য একটা ঘটনাকেও অনেক মধুর করে দেয়। বাস্তবতা থেকে দূরে নিয়ে যায়। (পৃ. ৪৪)
৩. চারদিকে সব সিরিয়াস মানুষ না? সিরিয়াস মানুষগুলো একটা কথা কিছুতেই বোঝে না যে, সিরিয়াসনেস একটা বোরিং ব্যাপার। (পৃ. ৪৫)
৪. এ জীবন কি সুন্দর নয়? রাস্তার ভিড়, জ্যাম, জীবনযাপনের জন্য মানুষের পরিশ্রম, তার ঘর্মাক্ত মুখ কি সুন্দর নয়? এসবই তো টিকিয়ে রাখছে পৃথিবীকে। ঃ আপনি এর থেকে মুক্তি নিয়ে কোথায় যাবেন? (পৃ. ৫১)
৫. আপনি বাথরুমে যাচ্ছেন, কাপড় বদলাচ্ছেন, গপ গপ করে খাবার গিলছেন। আরও কত কী হচ্ছে। এর মধ্যে মাঝে মাঝে আপনার মধ্যে ভালোবাসা যে জাগতে পারছে সেটা কি একটা দুর্লভ বস্তু নয়? (পৃ. ৫২)
৬. হয়তো অনিশ্চয়তার কথা জানি বলেই, সেখান থেকে পালিয়ে বেড়ানোর জন্যই আমাদের যত কিছু নিশ্চয়তার আয়োজন। (পৃ. ৬৫)
৭. জীবনের জন্য অনিবার্যতা বলে কিছু নেই। সবই নিবারণযোগ্য। (পৃ. ৮৯)
এই সকল স্মরণযোগ্য উক্তির ভিতর দিয়া পাঠক মানবচরিত্রের নানাবিধ অনাভাসিত দিককেই এ-উপন্যাসে উন্মোচিত হইতে দেখেন। এখন প্রত্যাশা এই যে, চরিত্রচিত্রণের মুনশিয়ানা, পটভূমি রচনার বাস্তবতাবোধ ও উপলব্ধির নৈর্ব্যক্তিকতার যে-পরিচয় মাহবুব মোর্শেদ তাঁহার এই প্রথম উপন্যাসটিতে নাজেল করিলেন, তাহা আগামীতে দেশ-কাল ও সমাজকে স্পর্শ করিবার মতো গভীরতর কোনও অনুষঙ্গ খুঁজিয়া পাইবে। অন্যথায় বেস্টসেলারের বিকল্প তো রহিলই।
লেখাটি নতুনধারা থেকে পুনপ্রকাশিত হলো।
বইয়ের দোকান থেকে মাহবুব মোর্শেদের ফেস বাই ফেস ডাউনলোড করুন।
কবিতাপাঠের রুচি যেন একপ্রকার নাছোড় ব্যাধি, যাহাদের আক্রমণ করে, সারা জিন্দেগির মতো তাহাদের ভোগাইয়া মারে। গল্প-উপন্যাস পাঠের মহৎ অভ্যাসটি, তুলনায়, আগ্রাসী জ্বরের মতো। কামড় বসাইলে রক্ষা নাই, কিছুদিনের জন্য ভিতর-বাহির তোলপাড় করিয়া ছাড়ে। কিন্তু একবার ছাড়িয়া গেলে সহসা আর ফিরিয়া আসে না। প্রিয় পাঠিকা-পাঠকের নিকট পহেলাই একথা কবুল করিয়া নেওয়া ভালো যে, এ-ব্যাপারে বর্তমান কথকের অভিজ্ঞতা প্রকৃতই শোচনীয়। একুশ শতকে প্রকাশিত বিভাগোত্তর প্রজন্মের মাত্র দুইটি বাংলা উপন্যাস পাঠের সৌভাগ্য আমাদের ঘটিয়াছে- ১. নবারুণ ভট্টাচার্য কৃত কাঙাল মালসাট (২০০৩) এবং ২. সালমা বাণী রচিত ভাংগারি (২০০৪)। অতঃপর আরও নবীন কোনও লেখকের রচনার সহিত পরিচিত না হইতে পারিলে বাংলা উপন্যাসের হাল-হকিকত সম্পর্কে এক প্রকার ভাসা ভাসা জ্ঞান (পড়ুন, পুস্তক পর্যালোচনা পাঠ প্রসূত জ্ঞান) লইয়াই ভবলীলা সাঙ্গ হইবে, এইরূপ একটি হীনমন্যতায় ভুগিতেছিলাম। এমতাবস্থায় জনৈক বন্ধুর বদান্যতায় হাতে আসিয়া পঁহুছিল একেবারে তরুণ এক গদ্যকার মাহবুব মোর্শেদ (জন্ম ১৯৭৭) রচিত একটি উপন্যাস- ফেস বাই ফেস (প্রকাশ, একুশে বইমেলা ২০১০)।
জমাটি গল্পকারের একটি বহুপরীক্ষিত কৌশল হইল, মোক্ষম তাসটি আস্তিনের নিচে চুপচাপ চাপিয়া রাখিয়া একেবারে অন্তিম মুহূর্তে পাঠকের টেবিলে ঠকাস করিয়া ফেলিয়া দিয়া তাহাকে কুপোকাত করা। এ-ব্যাপারে গোয়েন্দা বা ভূতের গল্পের সাফল্য মনে হয় সব লোকপ্রিয় লেখককেই তাড়া করিয়া ফেরে। গল্প বলিবার অন্য কিছু তরিকাও অবশ্য লেখকদের নিকট হইতে আমরা পাইয়াছি। যেমন, ১) রহস্য যদি আদৌ কিছু থাকে, তাহা প্রথমেই ফাঁস করিয়া দিয়া পরে তাহা লইয়া প্যাচাল পাড়া (সাহিত্যের ভাষায়, রহস্যটি বিনির্মাণ করা)। ২) জীবনের কোথাও কোনও রহস্য যে নাই, রহস্যহীনতার সেই হাহাকার হইতে কথা বলা। ৩) কথা বলিতে বলিতে রহস্যকে আবিষ্কার করা, যেন পাঠক আর লেখক একইসাথে তাহার মুখোমুখি হইলেন, এইরূপ একটি আবহ সৃষ্টি করা ইত্যাদি। দেখা গেল, মাহবুব মোর্শেদ তাঁহার প্রথম উপন্যাস ফেস বাই ফেস-এ, পাঠককে চূড়ান্তে চমক দিবার সনাতন ধারাটিকেই বাছিয়া লইয়াছেন। তাঁহার আস্তিনে লুকানো সেই যাদু-তাসটি হইল, উপন্যাসের কথক-নায়ক শুভর অন্যতম ও প্রধানতম বান্ধবী তিন্নির সমকামিতা। গল্পের একেবারে শেষে পঁহুছিয়া যে-তথ্যটি উদ্ঘাটিত হওয়ার সাথে সাথে পাঠকের সুনিশ্চিত বিস্ময়ের সম্ভাবনায় লেখকের ঠোঁটের কোণে ফুটিয়া উঠা তৃপ্তির হাসিটিও আমরা পড়িয়া লইতে পারি, যাহার অর্থ হইতেছে, কী, কেমন দিলাম।
বছর পাঁচেক আগে একটি পশ্চিম-ইউরোপীয় ছবিতে (নাম মনে নাই) নারীর সমকামিতার এক আগ্রাসী ও মারমুখী মূর্তি দেখিয়াছিলাম, সঙ্গিনীর বিষমকামী হইয়া উঠিবার সামান্য সম্ভাবনা দেখা দিলে আদিম ঈর্ষাবশে যে-প্রেম রক্তারক্তি, খুনোখুনি অবধি গড়াইয়াছিল। সম্পূর্ণ ভিন্ন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত হইতে উঠিয়া আসা এক বাঙালি মেয়ে বলিয়াই এ-উপন্যাসের তিন্নি সেসব অতিরেকের ধারকাছ দিয়াও যায় নাই। না যাইবারই কথা। সে শুধু তাহার সঙ্গিনী সুপর্ণার বিবাহের সম্ভাবনা একবার ভাঙিয়া দিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছে। কিন্তু তাহা যে স্রেফ একটি কুচুটেপনা মাত্র ছিল না, সে-বিষয়ে লেখক আমাদের পুরোপুরি নিঃসংশয় করিয়া তুলিতে পারেন না। কারণ, সুপর্ণার বিবাহসম্ভাবনাটি সে-যাত্রা ঘনাইয়া উঠিয়াছিল শুভ’র সহিত, যে-শুভ আসলে তিন্নিকেই কলেজজীবন হইতে ভালোবাসিয়া আসিয়াছে, কিন্তু বহু বছরের প্রতীক্ষাতেও কোনও ইতিবাচক সাড়া না পাইয়া শেষমেশ সুপর্ণার দিকে আগাইয়াছে ও জড়াইয়া গিয়াছে। তাই এ-ধন্দ থাকিয়াই যায়, অমন বিবাহটি তিন্নি ভাঙিল কেন, নিছক সুপর্ণার প্রতি আসক্তিবশত? তাহা হইলে অল্পকিছুদিন বাদেই যখন পারিবারিকভাবে পুনরায় তাহার বিবাহ ঠিক হইল, তিন্নি তো তখন কোনওরূপ বাধা দিল না! বরং সে সেই বিবাহবাসরের নিমন্ত্রণও গ্রহণ করিল। তাহা হইলে কি শুভকে অবিবাহিত রাখিয়া দিয়া, তাহার দুর্বলতার সুযোগ লইয়া তাহার উপর কর্তৃত্ব ফলানোর রাস্তাটাও তিন্নি খোলা রাখিতে চাহে নাই?
আসলে তিন্নির সমকামিতার আখ্যানটাই একটু নড়বড়ে, যেহেতু তাহা দাঁড়াইয়া আছে লেখকের ঐ একটি মাত্র যাদু-তাসের উপর। উপন্যাসের শেষে তিন্নির ফ্যাঁচফ্যাঁচে কাঁদুনির মৌখিক বয়ানের উপরে ভরসা করিয়াই আমাদের ব্যাপারটি গিলিতে হয়। প্রসঙ্গের কোনও পূর্বপ্রস্তুতি না রাখিয়া লেখক চমক দিতে চাহিয়াছেন, ভালো। কিন্তু প্রবণতার দিক হইতে চরিত্রটি যখন এক সংখ্যালঘু মানসের অধিকারী, তখন, অন্তত রহস্যটি ফাঁস হওয়ার পর, তাহার সেই মানস-জটিলতার স্তরপরম্পরাগুলি পাঠকের কাছে আরও বিশদ হইবার অবকাশ থাকিয়াই যায়। যেমন একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসাবে সুপর্ণা ও তাহার পারিবারিক পটভূমির বিশ্বাসযোগ্য রূপায়ণের একটা আলাদা চেষ্টা লইয়াছেন লেখক। তিন্নি চরিত্রের সেই অনুসন্ধানী বিশ্লেষণের অভাবে পাঠকের মনে কতকগুলি প্রশ্ন জাগে। সুপর্ণা যেহেতু যুগপৎ তিন্নির সমকামী সঙ্গিনী এবং শুভ’র প্রেমিকা, তাহাকে আমরা এক উভকামী নারী বলিয়াই ধরিয়া লইতে পারি। অন্যদিকে, তিন্নি যদি নিরঙ্কুশ সমকামী, তাহা হইলে সুপর্ণার বিচ্ছেদে হয় সে বিরহ উদ্যাপন করিবে, নচেৎ কোনও পুরুষ নহে, অন্য কোনও নারীরই প্রতি ধাবিত হইবে। কিন্তু যেভাবে সে শেষ পর্যন্ত শুভকে মানিয়া লয়, তাহাতে তাহার এক উভকামী সত্তার পরিচয়ই জাগিয়া উঠে। ইহা কি তাহার ভিতরে একটি নূতন উপলব্ধি? যদি তাহাই হয়, সেই মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার কোনও পরিচয় লেখক আমাদের দেন নাই। আর সে যদি প্রথমাবধিই উভকামী ছিল, তাহা হইলে শুভ আর সুপর্ণা দুইজনের সহিতই সম্পর্ক বহাল রাখিয়া, গল্পকে একটা অন্যতর মাত্রায় লইয়া যাইতে পারিত। কাজেই তিন্নির সমকামিতাটা শেষ পর্যন্ত একটা পড়িয়া পাওয়া চৌদ্দ আনা স্টান্ট হইয়াই থাকিয়া যায়।
২
উপন্যাসটির উৎসর্গপত্রে উৎকলিত কবি উৎপলকুমার বসুর পঙ্ক্তিগুলি বলিতেছে-
‘তোমাদের মজার এক গল্প বলি শোনো’ কে যেন বলল ডেকে,
কোন গল্প, কাকে নিয়ে, সমস্ত ভুলেছি। শুধু শালবনে- দূরে-
জলার মতন এক স্বচ্ছ জল অন্তিম গোধূলি নিয়ে
আলো হয়ে ছিল
তথাপি, শেষ পর্যন্ত মাহবুব মোর্শেদ যে আমাদের কোনও অন্তিম গোধূলি আলোর মুখোমুখি দাঁড় করান না, তাহার জন্য পাঠক হিসাবে তো কিছুটা প্রতারিত বোধ করিবারই কথা। কিন্তু সেটা ঘটে না, মুখ্যত লেখকের উপাদেয় লিখনভঙ্গিমা আর একাধিক বিশ্বাসযোগ্য চরিত্রের সফল উপস্থাপনার কারণে। সুনীল বা হুমায়ূনের রচনায় যে একধরনের সাবলীল সুখপাঠ্যতা থাকে, লেখক অনায়াসে সে-সাফল্য স্পর্শ করিয়াছেন। তিনি যদি শুধু এইটুকুই চাহিয়া থাকেন, তাহা হইলে অচিরেই বাংলাবাজারে আরও একজন বেস্ট সেলার লেখকের অভিষেক ঘটিতে চলিয়াছে, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তবে বাণিজ্যসফলতাই যে এ-লেখকের একমাত্র কাক্সিক্ষত নিয়তি নয়, তাহারও ঢের পরিচয় বর্তমান উপন্যাসটির পাতায় পাতায় ছড়ানো রহিয়াছে। যেকোনও স্বপ্নদর্শী তরুণের মতোই, জীবনের প্রথম উপন্যাসের করণকারিত্বে কিছু একটা অভিনবত্ব আমদানি করার কথা ভাবিয়াছেন তিনি। আর তাহা করিতে গিয়া, তৃতীয় বিশ্বের সমাজবাস্তবতার গহন ঘূর্ণিপাকে ডুব দিয়া নাকানিচুবানি খাওয়ার বদলে, তিনি বাছিয়া লইয়াছেন পৃথিবীর নানাপ্রান্তে গহন দ্বীপের মতো ছড়ানো কিছু মানবহৃদয়। সেইসব ছিন্নবিচ্ছিন্ন হৃদয়ের ঐক্যের পটভূমি হইল তাহাদের এক হইতে বহুতে পৌঁছানোর আকাক্সক্ষা, আর সেই দূরসঞ্চারের অবলম্বন হইল আন্তর্জাল।
আখ্যানের কথক শুভ যেহেতু কর্মসূত্রে আন্তর্জালের ব্যবহারকারী, অবসরের মন্থরতা কাটাইতে সে প্রায়শই ঢুকিয়া পড়ে বদনবই (ফেসবুক) নামের সামাজিক জালবুনটের জগতে। তাহার ল্যাপটপের পর্দায় জাগিয়া উঠে একের পর এক নানা দূরাগত অভিব্যক্তি। এইসব ধারাবাহিক মুখচ্ছবির ব্যঞ্জনা হইতেই উপন্যাসটির নাম হইয়া উঠে ফেস বাই ফেস। যেখানে একের পর এক নানা বয়সের নানা বাঙালি নারীপুরুষ কথা বলিয়া উঠে হরফের ভাষায়। মুছিয়া যায় শারীরিক ব্যবধান, কখনও কখনও যে-দূরত্ব হয়তো ভূগোলের মাপে কয়েক হাজার কি.মি.। এই উপন্যাসে মাহবুব মোর্শেদের সর্বাপেক্ষা বড় কৃতিত্ব হইল এই ভার্চুয়াল চরিত্রগুলির সৃষ্টি। নাজিয়া, সাবিনা মেহনাজ, শেরি, মারিয়া, মাধবীÑ প্রতিটি চরিত্র এত আলাদা, অথচ প্রতিটিই এমন বিশ্বাসযোগ্য হইয়া উঠিয়াছে যে, লেখকের সহিত আমরাও চরিত্রগুলির শ্বাসপ্রশ্বাস অনুভব করি।
কিন্তু লেখক বিলক্ষণ জানেন, নিছক চমকপ্রদ কিছু চরিত্র সৃষ্টি করিয়া ফেলিলেই পাঠকের মন পাওয়া যাইবে এমন নহে। তাহার জন্য গপ্পো ফাঁদিতে হইবে। লেখক কাজেই দুই নৌকায় পা দিয়াছেন, যদিও যেকোনও সৃজনশীল মানুষের মতোই সে-অধিকার তাঁহার আলবাত আছে। তিনি শুধু অথই দরিয়া হইতে জালে তোলা মাছেই খুশি থাকেন নাই, পোক্ত হাতে হুইল-বঁড়শি দিয়া কাছাকাছি ঝিল-নালা-পুকুরের মাছ তুলিতেও কসুর করেন নাই। গ্লোবালের মোড়কের আড়ালে তাঁহার গল্প আসলে এইসব লোকালদের লইয়াই দিব্য আড়ে-বহরে খেলিয়া গিয়াছে। এইসব স্থানীয় চরিত্রগুলির জন্য বদনবইয়ের অবতারণা অবশ্য একটি বাহানা মাত্র। তাহাদের লইয়া গল্প যেভাবে আগাইয়াছে, সেখানে বদনবই না থাকিলেও এমন কিছু আসিয়া যাইত না। তবে থাকাতেও অসুবিধা কিছু হয় নাই, মাঝে মাঝে বরং বৈচিত্র্যও তৈরি হইয়াছে। যেমন নওরোজ ভাইয়ের তারুণ্যে উদ্দীপ্ত চরিত্রটি। পরার্থপর ও শুভমঙ্গলবাদী জীবন সাহাও এক চমৎকার সৃষ্টি। সমকামিতাটা তাহার জন্য যতই আলংকারিক মনে হউক, তিন্নি কিন্তু পাঠকের মন কাড়িয়া লয়। শুভকে কেন্দ্র করিয়া তাহার স্ববিরোধী ও প্রাণচঞ্চল চরিত্রটির উন্মোচন খুবই বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপিত হইয়াছে। তুলনায় সুপর্ণার চরিত্রায়ন একটু আড়ষ্ট। তাহার ও শুভর আপাতকাব্যিকতাময় যৌথদৃশ্যগুলি কথঞ্চিৎ সু.গ-মার্কা। কিন্তু চিরকিশোর পাঠকদের জন্য বাণিজ্যসাহিত্যের নির্মাতা প্রাগুক্ত লেখকের কাঁচা ও জোলো রোমান্টিকতা (পড়ুন, শারীরিকতা) বড় বেশি ছায়া ফেলিয়াছে রওনক ভাবীর সহিত শুভর ডেটিংয়ের দিনটিতে। অন্যথায় ভাবীর চরিত্রটি কিন্তু নওরোজ ভাইয়ের পরিপূরক হিসাবে ভালোই জমিয়াছিল।
ফয়সল ভাইয়ের চরিত্রটি এ-উপাখ্যানে সম্পূর্ণ অনাবশ্যকভাবে আসিয়া গিয়াছে বলিয়া মনে হয়। যেন ২৫ গ্রাম জ্যোতিষ আর ৫০ গ্রাম পানশালা-দৃশ্যের অবতারণা করিবার জন্যই তাহার সৃষ্টি। তাহাকে বানাইয়া বলা স-সুপর্ণা-শুভ’র রাজস্থান ভ্রমণবৃত্তান্তটিও হইয়া উঠিয়াছে যাদুবাস্তবতা সৃষ্টির একটি ব্যর্থ প্রয়াস। সহস্রযোজন দূরের নায়াগ্রাপ্রপাতের জলধ্বনিও যেখানে বিশ্বাসযোগ্যভাবে অনুরণিত হইতে পারিল, রাজস্থানের মরু পাঠকদের কেন প্রতারিত করিল কে জানে! হয়তো বানাইয়া বলিতেছেন বলিয়া লেখক এরূপ সচেতন ছিলেন যে, প্রাণপ্রতিষ্ঠা হইল না। নায়াগ্রা ও পিংক সিটির অভিজ্ঞতা বর্ণনার সামান্য কিছুটা করিয়া অংশ পাশাপাশি পাঠ করিলেই ইহাদের শিল্পমাত্রার তারতম্য আমাদের চোখে ধরা পড়ে-
টানেল ধরে যখন জলপ্রপাতের একদিক থেকে অন্যদিকে যাচ্ছিলাম মনে হচ্ছিল প্রচণ্ড গর্জনের ভেতর হারিয়ে গিয়েছি। হয়তো এ রকম প্রচণ্ড বা এর চেয়ে তীব্র কোনো গর্জনের ভেতর ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। শব্দের প্রচণ্ডত্বের মধ্যেও মানুষ যে হারিয়ে যেতে পারে নায়াগ্রা না গেলে বুঝতাম না। (পৃ.২৩) [ভাষা প্রাণবন্ত এবং কবিতামণ্ডিত]
চাঁদ তখন মাঝ আকাশে। পূর্ণ আলো ফেলেছে শহরের খোলা স্থানে। তার বিভা মরুর বুকে একটা গোলাপি ফুল ফুটিয়ে দিয়েছে। ছোট ঘরগুলো সেই গোলাপি ফুলের এক একটি পাপড়ি। তখন পুরো শহর ঘুমিয়ে পড়েছে। নৃত্যলহরীর সঙ্গে আসা গান থেমে গেছে। ছোট নির্জন ছাদে আমি আর সুপর্ণা। (পৃ. ৮৬) [ভাষা অসংহত ও কাব্যিকতাপ্রয়াসী]
এ-উপন্যাসের ভাষার সাবলীলতার উল্লেখ আমরা ইতোমধ্যেই করিয়াছি। পরিবেশ প্রতিষ্ঠার দক্ষতায় মাহবুব প্রায়শই সেই প্রাথমিক সাফল্যকে টপকাইয়া যে-শিল্পিত আবহের সৃষ্টি করেন, তাহার দু’একটি নমুনায় একবার চোখ বুলাইয়া লইতে পারি-
১. তার মাঝে মাঝে মনে হতো, কুইবেকে সেই একলা বাড়িতে গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসবে। চারদিকে সার সার বার্চ গাছ। তুষার জমে পার্কের জমিন শাদা হয়ে আছে। তীব্র কুয়াশার মধ্যে যেখানে মারিয়া হেঁটে হেঁটে উজ্জ্বল আলো ভরা স্টোরে চলে যায়। (পৃ. ৬৯)
২. তখন বর্ষাকাল, আকাশে মেঘ কিন্তু দূরে দূরে। পাকশী আসার আগেই ট্রেনলাইনের দুপাশের সবুজ ঘন গাছপালার প্রেমে পড়ে যাচ্ছিলাম। দূরের বাজার, কাছের মানুষ, খুব ভালো লাগছিল। ট্রেন ব্রিজের ওপর উঠার আগেই দেখলাম এক অপূর্ব জলমণ্ডল। সন্ধ্যার আলো তখনও মেলায়নি। নীল জলে একটু একটু একটু শাদা-কালো মেঘের স্পষ্ট প্রতিবিম্ব। (পৃ. ৭১)
৩. ক্ষেতের ধারে শর্ষের ঝাঁঝালো গন্ধ নেয়ার পর দূরের গ্রাম লক্ষ্য করে আবার হাঁটতে থাকি। শাদা মূলার ফুল ফুটে আছে। তারও অন্যরকম ঝাঁঝালো গন্ধ। মটরশুঁটি। ডাঁটা শাক, লাল শাক, করলার ক্ষেতের আল ধরে ধরে একটা গ্রামে পৌঁছাই। কয়েকটা বাড়ি। কয়েকটা তালগাছ। একটা ছোট টংয়ের দোকান। (পৃ. ১০৭)
প্রকৃতিবর্ণনার এই বহুবিধ পাঁয়তারা (শব্দটি এখানে প্রশংসার্থে ব্যবহৃত হইল) ছাড়াও বহু গভীর দার্শনিক উপলব্ধি, চমকপ্রদ উক্তি, ফাজলামি, কৌতুক ইত্যাদি উপন্যাসটির পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ছড়াইয়া আছে।
১. নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় নাকি ঐতিহাসিক স্থান দেখার মতো অনুভূতি তৈরি করে।
২. স্মৃতিচারণ খুব খারাপ জিনিস। স্মৃতি অতীতের কদর্য একটা ঘটনাকেও অনেক মধুর করে দেয়। বাস্তবতা থেকে দূরে নিয়ে যায়। (পৃ. ৪৪)
৩. চারদিকে সব সিরিয়াস মানুষ না? সিরিয়াস মানুষগুলো একটা কথা কিছুতেই বোঝে না যে, সিরিয়াসনেস একটা বোরিং ব্যাপার। (পৃ. ৪৫)
৪. এ জীবন কি সুন্দর নয়? রাস্তার ভিড়, জ্যাম, জীবনযাপনের জন্য মানুষের পরিশ্রম, তার ঘর্মাক্ত মুখ কি সুন্দর নয়? এসবই তো টিকিয়ে রাখছে পৃথিবীকে। ঃ আপনি এর থেকে মুক্তি নিয়ে কোথায় যাবেন? (পৃ. ৫১)
৫. আপনি বাথরুমে যাচ্ছেন, কাপড় বদলাচ্ছেন, গপ গপ করে খাবার গিলছেন। আরও কত কী হচ্ছে। এর মধ্যে মাঝে মাঝে আপনার মধ্যে ভালোবাসা যে জাগতে পারছে সেটা কি একটা দুর্লভ বস্তু নয়? (পৃ. ৫২)
৬. হয়তো অনিশ্চয়তার কথা জানি বলেই, সেখান থেকে পালিয়ে বেড়ানোর জন্যই আমাদের যত কিছু নিশ্চয়তার আয়োজন। (পৃ. ৬৫)
৭. জীবনের জন্য অনিবার্যতা বলে কিছু নেই। সবই নিবারণযোগ্য। (পৃ. ৮৯)
এই সকল স্মরণযোগ্য উক্তির ভিতর দিয়া পাঠক মানবচরিত্রের নানাবিধ অনাভাসিত দিককেই এ-উপন্যাসে উন্মোচিত হইতে দেখেন। এখন প্রত্যাশা এই যে, চরিত্রচিত্রণের মুনশিয়ানা, পটভূমি রচনার বাস্তবতাবোধ ও উপলব্ধির নৈর্ব্যক্তিকতার যে-পরিচয় মাহবুব মোর্শেদ তাঁহার এই প্রথম উপন্যাসটিতে নাজেল করিলেন, তাহা আগামীতে দেশ-কাল ও সমাজকে স্পর্শ করিবার মতো গভীরতর কোনও অনুষঙ্গ খুঁজিয়া পাইবে। অন্যথায় বেস্টসেলারের বিকল্প তো রহিলই।
লেখাটি নতুনধারা থেকে পুনপ্রকাশিত হলো।
বইয়ের দোকান থেকে মাহবুব মোর্শেদের ফেস বাই ফেস ডাউনলোড করুন।