Boierdokan
স্যোশাল মিডিয়ায় বইয়ের দোকান
  • উঠান
  • ই-বই মেলা ২০১৩
  • গল্প
  • কবিতা
    • কবিতা-১
    • কবিতা-২
  • নন-ফিকশন
  • উপন্যাস
  • নাটক
  • সমালোচনা
  • পত্রিকা
  • চিরায়ত
  • English Books

খালেদ হোসাইনের ‘পাতাদের সংসার’ : ঋতুমতী আলোর উত্থান

13/5/2012

3 Comments

 
আরিফ ওবায়দুল্লাহ

‘পাতাদের আবার সংসার হয় নাকি?’- পড়ার টেবিল থেকে বইটি হাতে নিয়ে এমনই প্রশ্ন ছিল এক বন্ধুর। বললাম পাতা কেমন?-খালেদ হোসাইনের ‘পাতাদের সংসার’ : ঋতুমতী আলোর উত্থান হতে পারে সবুজ, স্নিগ্ধ, হতে পারে জীর্ণ। এটা  তো বৃক্ষই ধারণ করে; সময় শেষে ঝরে যায়, খ’সে পড়ে কিংবা ঝরানো হয়। ধর এই বৃক্ষটাই পৃথিবী আর তুমি পাতা। এইবারে বল তোমার কি সংসার নেই? তুমি কি ঝরবে না? দেখ কবিরা কীভাবে পাতা দিয়ে সংসার গড়ে! অবাক বন্ধু, বই হাতে ধীরে ধীরে উল্টাতে লাগল পাতা। কথা বলছিলাম কবি খালেদ হোসাইন (জন্ম-১৯৬৪)- এর ‘পাতাদের সংসার’ কাব্যগ্রন্থ প্রসঙ্গে। অমর একুশে বইমেলা ২০০৭-এ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। পূর্বে কবির তিনটি কাব্যগ্রন্থ যথাক্রমে ‘ইলামিত্র ও অন্যান্য কবিতা’ (২০০০), ‘শিকার-যাত্রার আয়োজন’ (২০০৫) এবং ‘জলছবির ক্যানভাস’ (২০০৬) আমরা হাতে পাই। এর পরে প্রকাশিত হয়েছে এক দুপুরের ঢেউ (২০০৮), পায়ের তলায় এসে দাঁড়িয়েছে পথ (২০০৯), চিরকাল আমি এখানে ছিলাম (২০১০) ও পথ ঢুকে যায় বুকে (২০১১)  প্রতিষ্ঠালব্ধ আশির দশকের কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ শূন্য দশকে প্রকাশ! বোঝাই যায় কতটা নিরীক্ষাপ্রবণ আর আত্ম-নিয়ন্ত্রিত তিনি। আর এ কারণেই তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থই স্বতন্ত্র স্বাদে আস্বাদিত হয় পাঠকের কাছে, ‘পাতাদের সংসার’ও এর ব্যতিক্রম নয়।
    প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ইলামিত্র ও অন্যান্য কবিতায়’ কবিকে অতটা শক্তি ও গতিময়তা নিয়ে আবির্ভূত হতে আমরা দেখি না, যতটা শক্তি ও কারিশমা পরবর্তী গ্রন্থগুলোতে রয়েছে। বোধ হয় প্রথম গ্রন্থ বলে নানা সংশয় স্বভাবত তিনি এড়াতে পারেননি। কবিও হয়তো তা উপলব্ধি করেছিলেন। আর তাই দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘শিকার যাত্রার আয়োজন’ হাতে পেতে পাঠককে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ পাঁচ বছর। এ গ্রন্থের ভাষা-বিন্যাসে শামসুর রাহমানের একটা বিশেষ প্রভাব পরিলতি হলেও দীর্ঘ কবিতার অনন্য স্বর ও নানা ব্যঞ্জনায় গ্রন্থটি বৈচিত্র্য-ভাস্বর। এরপর চারটি মাত্র দীর্ঘ কবিতা প্রকাশিত হয় ‘জল ছবির ক্যানভাস’, যা তাঁর গতিময়তা ও সচেতন পরিচর্যার পরিচায়ক, যেখানে তিনি মুখ্যত বহুধা-ব্যাপৃত ইতিহাসের পর্যবেক্ষক। পরের কাব্যগ্রন্থগুলো নানা বৈশিষ্ট্যে স্বকীয় হলেও এখানে আমাদের আলোচনার উপজীব্য ‘পাতাদের সংসার’।   
    বিষয় ও আঙ্গিক বিবেচনায় ‘পাতাদের সংসার’ কবির পূর্ববর্তী তিনটি কাব্যগ্রন্থ থেকে ভিন্নমাত্রার, অন্য বা অনন্য সুরের । প্রকৃতির সাথে সহবাস করে কবির নিরীক্ষা চলেছে সনেটের ছন্দ-কাঠামো নিয়ে। উপমা ও চিত্রকল্পের বিবিধ বুননে কবিতা-পঙ্ক্তিগুলো পেয়েছে নানা মাত্রা। আবার কখনো কখনো অপ্রচলিত এবং আঞ্চলিক শব্দ প্রয়োগে কবি ভিন্ন একটা আবহ সৃষ্টির প্রয়াসী। প্রকৃতিকে অবলম্বন করে লেখা হলেও কাব্যগ্রন্থটিতে মূলত সমকালীন সমাজ-মনস্কতা, প্রেম-চেতনা, বিচিত্র বেদনাবোধ ও হাহাকারের চিত্র মূর্ত হয়ে উঠেছে।
        আটচল্লিশটি কবিতা নিয়ে ‘পাতাদের সংসারে’র প্রতিটি কবিতাই চৌদ্দ পঙ্ক্তির। সনেটের আদল তবে কবির সচেতন প্রয়াস-প্রোথিত। কখনো মাত্রাবৃত্ত, কখনো অরবৃত্ত আবার কখনো প্রবহমাণ মুক্তকে কবি পথ চলেছেন। গ্রন্থের নাম-কবিতা ‘পাতাদের সংসার’- এ সনেটের চরণান্তিক মিলবিন্যাস রতি হয়েছে :
পাতাদের সংসারে/ উড়ে আসে ফাগুনের/ নদী    ৮/৮/২
পাতাদের সংসারে/ নীরবতা জুড়ে দেয়/ নাচ    ৮/৮/২
অনেক বিরহ-কাল/ পার হয়, একবার / যদি    ৮/৮/২
সোনালি অগ্নিকণা / ছুঁড়ে দেয় জীবনের / আঁচ।    ৮/৮/২
পাতাদের ঘর-দোরে/ বায়ু এসে দিয়ে যায়/ দোলা    ৮/৮/২
পাতাদের আঙিনায়/ ছায়া ফেলে শূন্য আ/কাশ    ৮/৮/২
পাতাদের অন্তর/ উদাস মাঠের মতো / খোলা     ৮/৮/২
সেখানেও বাস করে/ গুম-খুন, শ্বেত-সন্ত্রাস।    ৮/৮/২

                                                              [‘পাতাদের সংসার’]
 কখকখ গঘগঘ গঙগঙ চচ- এই বিন্যাসে ৮ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা কবিতাটি সনেটের ভাব ও সৌকর্য বহন করছে তা বলা যায়। তবে গ্রন্থের সব কবিতাই সনেটের ভাব বহন করছে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় না। গ্রন্থটিতে কবির ছন্দের নিরীক্ষা কেবল নিবিড় পাঠেই উপলব্ধি-সম্ভব। বেশিরভাগ কবিতার পঙ্ক্তিগুলো ৮/১০ মাত্রার অক্ষরবৃত্তে লেখা। যেমন ‘যারা উভচর’ কবিতায় :
প্রতি রোমকূপে ওড়ে/ আত্মঘাত স্বতঃপ্রণোদিত    ৮/১০
সপ্রতিভ আগুন্তুক/পরিতৃপ্ত কথোপকথনে        ৮/১০
শাদা বক ডানা নাড়ে/ আঠালো রাতের সীমানায়    ৮/১০
দায়বোধ অন্তরিন/ কারাগারে কিংবা নির্বাসনে।      ৮/১০
কিংবা,
মণি-কাঞ্চনের লোভে/ গড্ডলিকা প্রবাহে ভেসেছ    ৮/১০    
ভুলে গেছ বৃন্দাবন/ ভ্রমণের কান্তিহীন স্পৃহা    ৮/১০
শুকপক্ষে খসে পড়ে/ অন্ধকার বেনারসি শাড়ি    ৮/১০
আক্রান্ত রাতের ভাষা/ কঙ্গুচিনা ধানের কঙ্কাল     ৮/১০
                      [‘ধানপরী’]
‘পাতাদের সংসার’-এ উপমার নান্দনিক প্রয়োগ পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না। ‘রাধার চোখের মতো জলদিঘি চুম্বনে অস্থির’, ‘পুরানো থামের মতো ধসে পড়ে মানুষের মন’, ‘বালির বাঁধের মতো গলে যায় সেগুনের খাট’, ‘বিষের বড়ির মতো গিলে খাব পাপ’, ‘ভরা কলসের মতো অতিরিক্ত ঠাণ্ডা ও চুপচাপ’, ‘নির্ঘুম চোখের মতো জেগে থাকে প্রান্তরের পথে’ কিংবা ‘এখনও পিয়াল ফল ঘাসের স্তনের মতো কাঁদে’ এমন অনেক উপমার প্রয়োগ নিঃসন্দেহে গ্রন্থের কবিতাগুলোকে ঋদ্ধ করেছে। ‘কড়িকাঠ’ কবিতায় একসঙ্গে একাধিক উপমার উপস্থিতি লক্ষ্য করার মতো :
জাহাজের ডেকে খালি বোতলের মতো গড়াগড়ি
খেতে খেতে জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গেছ
            ...
            কচুরিপানার মতো বৃক্ষশাখা দূরে ভেসে যায়
            ...
            ফাঁসের দড়ির মতো কড়িকাঠে তাকে বেঁধে রাখে।
 
                        [‘কড়িকাঠ’]
শুধু উপমাই নয় পাশাপাশি অসাধারণ চিত্রকল্পের ব্যবহার কবির কবিতায় আমরা পাই। কবিতায় কম প্রচলিত শব্দাবলি দিয়ে চিত্রকল্পের যে গাম্ভীর্যপূর্ণ বুনন তিনি এঁটেছেন পাঠককে তা উপলব্ধি করতে হয় অদ্ভুত অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে :  

‘আমি আর বালিশের জরায়ুতে ডানাছাঁটা তুলো
নই, সাবানের পিচ্ছিলতা নই, অন্ধঘেঁটুবনে
পিতলের আংটি নই।’

[‘সীমান্তেও সুখ নেই’]
চিত্রকল্পের ব্যবহার সবসময় যে গাম্ভীর্যপূর্ণ এমন নয়। সরল বর্ণনায়ও এর প্রয়োগ ঘটেছে :
এখন তো উদ্দীপনা অনায়াসে সিঁড়ি ভাঙে আর
খোলা পিঠে হাত রাখে; গন্ধময় চুলের বিন্যাস                      
তছনছ করে, কফি-মগ পাশে রেখে তোমার অধরে
চুমুর আল্পনা আঁকে।

[‘মহোৎসব এখন তোমার’]
কবিতায় অপ্রচলিত ও আঞ্চলিক কিছু শব্দ ব্যবহার করে কবি খালেদ হোসাইন তাঁর কবিতায় একটা স্বতন্ত্র ভুবন নির্মাণে প্রয়াসী। ‘সার বাঁধা’, ‘চাতাল’, ‘জালালি কৈতর’, ‘অন্ধ ঘেঁটুবন’ এমন আঞ্চলিক শব্দ কিংবা ‘রাত্রির চোয়াল’ ‘হাড়-হাভাতের’, ‘নাভিকেন্দ্র’, ‘ডানাছাটা তুলো’ প্রভৃতি শব্দের নতুনরূপে প্রয়োগ কবিতাগুলোতে এনেছে ভিন্নমাত্রা এবং নিঃসন্দেহে বলা যায় তা কবির স্বতন্ত্র ভুবন নির্মাণ-প্রচেষ্টারই পরিচায়ক।
প্রকৃতির সাথে কবির হৃদ্যতার পরিচয় কাব্যগ্রন্থের পাতায় পাতায় ছড়ানো। ‘পাতাদের সংসার’ নামকরণের মধ্যেই এ সচেতনতা পরিলতি। বই খুলেই আমরা পড়ি :
    আমাকে দেখতে হবে ঋতুমতী আলোর উত্থান।
বাদলের কাল গেলে কদম কি সুগন্ধ ছড়ায়।
এ প্রকৃতির বর্ণনা কিন্তু নিছক প্রকৃতির নয়। কবি প্রকৃতির সাথে সহবাস করে তার রূপ ছেনে ও ছেঁকে কবিতায় গাঁথছেন একটা ভিন্নমাত্রা একটা ভিন্ন আবহ সৃষ্টির লক্ষ্যে, পাঠক পড়ামাত্র তা উপলব্ধি করতে পারেন আর পাঠকও চলে যান এক ভিন্ কল্প-জগতে :  
মনে হয় আমি নেই শ্রাবণের ধারাজল আছে
গেরুয়া মাটির গন্ধে উদাসীন তোমাদের বাড়ি
দেয়ালের শাদা রঙ লাল টালি জটিল আকাশ
আঙিনায় ভিজে যাচ্ছে তোমার শুকোতে দেয়া শাড়ি।

                        [‘গরুয়া মাটির গন্ধে’]
খালেদ হোসাইনের কবিতায় মিথের প্রয়োগ কম। যে দুয়েক জায়গায় মিথের উপস্থিতি আছে তাতে কবির সচেতন প্রয়োগভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছে। যেমন ‘রূপকথা’ কবিতার কথা বলা যায়। জায়সির ‘পদুমাবৎ’ কিংবা আলাওলের ‘পদ্মাবতী’র ‘হীরামন’ পাখি এ  কবিতায় ভিন্নমাত্রা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে :
মর্মান্তিক জলগন্ধ নিয়ে
শব্দ থেকে ঝরে পড়ে অর্থের সমস্ত দায়ভার
রূপার গাছের ডালে হীরামন দেখে তা তাকিয়ে।

                            [‘রূপকথা’]
সরাসরি মিথ বলা যায় না কিন্তু মিথের সাথে সম্পর্ক আছে এমন বেশ কিছু শব্দ কবি প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যেমন ‘নৌকাখণ্ড’, ‘কুরুত্রে’, ‘টোটেম’, ‘ত্রিশূল’ প্রভৃতি শব্দাবলি পঙ্ক্তিগুলোতে অনন্য ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে :
‘সায়াহ্নের সাজগোজে রজনির বাণিজ্য বদলায়
তুমি যদি আস, বন্ধু, নৌকাখণ্ড তোমাকে শেখাব।’

            [‘নৌকাখণ্ড’]
কিংবা,
তাই বলি ঘুরে এসো মেঘনা নদীর দুই পার
ফিরে এল দেখা হবে কুরুক্ষেত্রে কখনো আবার।

                        [‘অশ্র“ও সঙ্গতি খোঁজে’]
অথবা,
অদূরে ধানের ক্ষেতে কাদাজল আর পাঁতিহাস
সম্পর্ক রচনা করে ভেঙে সব টেবু ও টোটেম।
ত্রিশূলের গর্ত আছে বটগাছে নেই শ্বাসমূল
তিসিতেল গায়ে মেখে নামি যদি যমুনার জলে।

        [‘আশ্বিনের বায়ুকে বললাম’]

পুরাণের রাধাকেও কবি গেঁথেছেন বিভীষিকাময় আর্তিতে এভাবে :

তোমার মর্মার্থ শুধু শরীরেই গাঁথা নয়, রাধা,
হাসি বা কটাক্ষে তুমি জ্বাল যত আগুনের শিখা-
ষোড়শীর ইন্দ্রজালে চাঁদের রেশমি আলো নেই;
পায়ের পাতার নিচে রোদ-ঝলসানো বিভীষিকা।
 
                        [‘তোমার মর্মার্থ রাধা’]

এই কবিতায় রাধার বিনির্মাণ ঘটেছে। এ রাধা একেবারেই মর্ত্যলোকের কোন-এক প্রেমিকা রাধা; পুরাণের সাথে যেন এর কোন যোগ নেই।
    বাঙালির স্বর্ণালী দিনগুলো যেন কেবলি স্মৃতি। যে ঐতিহ্য আর ঐশ্বর্য এতকাল বাঙালি লালন করেছে তা আজ লুপ্ত অতীত। আর তাই ঐতিহ্য হারিয়ে কবি বেদনাবিদ্ধ :
                চরণে রূপার মল পাটের সৌরভে যেন নাচে
      দু-সিদ্ধ ধানের সোনা পায়ে পায়ে গেয়ে উঠত গান
     সেইসব রূপকথা - ঝলসে গেছে আগুনের আঁচে।
কিংবা,
                সোনার মুকুট পরে অনেক শতক চলে গেছে-
                পৃথিবী অনেক বড়, তোমার স্বজন নয় কেউ।
                এই পৃথিবীরও তুমি কেউ নও, যেন পুতুলের
                একান্ত দুঃখের অন্ধ নদী বয়ে এনেছে তোমাকে
                            
                            [‘হাত’]
হতাশা-নৈরাশ্যও কবিকে গ্রাস করেছে। ফলে এক ধরনের ক্ষোভ থেকেই উচ্চারিত হয়েছে :
             যেখানে বঞ্চনা ছাড়া আর কোনো ফসল ফলে না
সে প্রান্তরে আমি থাকি, সেখানে প্রতিটি ক্ষণ কালো
...
            এখানে শুশ্রূষা নেই কোনো জলতরঙ্গের মতো
            প্রতিটি মুহূর্তে মরে প্রতিটি মুহূর্তে বেঁচে থাকি।

                    [‘প্রতিটি রাতের গল্প’]
মুহূর্তে মুহূর্তে মরে এ অসম্ভব বেঁচে থাকার মানে কবি খুঁজতে চান না। আর তাই এ কালোছায়ার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে কবি দহন-প্রত্যাশী :
বেঙ্গমা-বেঙ্গমী নয় আমার গাছের ডালে কাক;
নরকের অগ্নি এসে যত পারে আমাকে পোড়াক।

                    [‘গেরুয়া মাটির গন্ধে’]
সমগ্র কাব্য জুড়ে যেখানে প্রকৃতির অনুধ্যান সেখানেও সমকালীন বাস্তবতা খালেদ হোসাইনের কবিতায় লক্ষণীয়; ‘সীমান্তেও সুখ নেই’ কবিতাটি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলাদেশের সীমান্ত-জেলা চাঁপাই নবাবগঞ্জের কানসাটে কৃষকের ন্যায্য দাবিতে যে রক্তয় ঘটেছিল তার বর্ণনা কবি করেছেন এভাবে :
কানসাটে রক্ত আর ঘাম
কালাইয়ের রুটি হয়ে পাকা মরিচের মতো লাল।
সীমান্তেও সুখ নেই- খা খা বুক -

                    [‘সীমান্তেও সুখ নেই’]
কবি খালেদ হোসাইন রোমান্টিক। প্রেমিকার প্রতি অসামান্য আবেদন তাঁর কবিতায় লক্ষ্য করার মতো। কোথাও যেন প্রেমিকা-হারানোর বেদনায় তিনি বিদ্ধ নন। বরং নিদ্রামগ্ন কবিকে রমণীয় সুখ নিয়ে জাগিয়েছে অস্থির প্রণয়িনী। সেজন্যই কবি বলছেন :

আমাকে জাগালে কেন অস্থিরতা, তীর ছুঁড়ে ছুঁড়ে?
শীত-ঘুমে মগ্ন আমি ছিলাম স্বপ্নের জটাজালে
বাস্তবের মোহমুক্ত যেন এক নিদ্রিত প্রান্তর
যে ভুলেছে জীবনের অলিগলি চাহিদা ও তাপ।
        [‘আমাকে জাগালে কেন, অস্থিরতা?]
আর কবি তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছেন অবশেষে এভাবেই :
অমৃতপাত্র শেষাবধি ভরে ওঠে বিষে।
তার চেয়ে চলে যাও, ফেলে আসা যমুনার তীরে
অগ্রন্থিত কবিতার দুঃখবোধ সর্ব অঙ্গে মেখে
[‘ভূর্জপত্রে অথবা বল্কলে’]
জীবনানন্দ দাশের প্রভাব ঠিক নয়, তবে এক ধরনের আবহ সৃষ্টির সচেতন প্রয়াস কবি খালেদ হোসাইনের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। জীবনানন্দ পথ হেঁটেছেন হাজার বছর। অনেক খুঁজে সিংহল সমুদ্র ঘুরে নাটোরে এসে ঠেকেছেন বনলতার পাশে আর খালেদ হোসাইন খুঁজছেন এভাবে :
সব খুঁজেছি, দেখি, তুমি নেই, আলোড়ন আছে;
শীতল্যা-ঘাট থেকে নৌকা যেত সুমাত্রা জাভায়
সেসব জলার্দ্র স্মৃতি রক্ত-কণিকায় আজও নাচে
তাম্রলিপি-নিকোবর ভরে ওঠে অযুত আভায়।
আফ্রিকার উপকূলে নেচেছিল তোমার সৌরভ
যেন মত্ত কানামাছি - ছুঁয়েছিল মালয় প্রণালী
আত্রাই নদীর বুকে উপচে-পড়া বাণিজ্যের রব
...
যা কিছু হারিয়ে যায় ফিরে আসে পার্বণের শেষে
ধূমল মেঘের মতো  চিরন্তন এই বাংলাদেশে।
[‘জলার্দ্র স্মৃতি’]

সবশেষে বলা যায় ‘পাতাদের সংসার’ পাঠে অনুভূত হয় লোভ জাগানিয়া সুখ। পাঠক আকৃষ্ট হন বারবার পাঠ নিতে। কবি খালেদ হোসাইন যে দীপ্তি ও ঔজ্বল্য নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন তা দীর্ঘ পথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে নিজস্ব গন্তব্য খুঁজে পাক- পাঠকের প্রত্যাশা এ-ই।

পাতাদের সংসার : খালেদ হোসাইন, প্রকাশক : রবিউল হোসের কচি, স্বরাজ প্রকাশনী, আজিজ মার্কেট, ঢাকা, প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : ধ্রুব এষ, মূল্য : ৭০ টাকা

3 Comments
SHakoor majid
13/05/2012 7:11am

Eto chomotkar porjalochona mulok alochona ami khub kom e porechi.

Reply
najnin akter
02/02/2013 9:43pm

কবি খালেদ হোসাইনের অন্তর্গঠন যেন কিছুটা হলেও চোখের সামনে দেখতে পেলাম । অভিনন্দন লেখককে ।

Reply
rezwana abedin
03/02/2013 5:24am

ভালো লাগলো.....বেশ গোছানো.....!!!!!!!

Reply



Leave a Reply.

    Author

    Boier Dokan

    Archive

    October 2012
    May 2012
    April 2012
    December 2011
    November 2011

    Categories

    All
    কবিতা
    উপন্যাস

    RSS Feed


Powered by Create your own unique website with customizable templates.