খালেদ হোসাইন
সত্যি কি কবি নিজের জোরে মাতাল নাকি অন্য কেউ মাতিয়ে তোলে তাঁকে? লৌকিক বা অলৌকিক কোনো শক্তি বা অন্য কিছু? জীবনে দুঃখ যেমন সত্য, আনন্দ-উৎসবও তো তাই। তবু কেন কবি বলেন, ‘উৎসবের কথা আমি কহি নাকো?’শেলী কেন বলেন, ‘আমাদের মধুরতম সংগীত সেইগুলো, যেখানে বর্ণিত হয়েছে দুঃখানুভূতি?’ কেন রবীন্দ্রনাথের মনে হয়, ‘অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেন/ তার বে বেদনা অপার?’ কবি তবে বেদনারই মানসপুত্র? কবি যদি বেদনার মানসপুত্র বা কন্যা, তবে তিনি কেন ইস্তফা দিয়ে বেছে নেন না অন্য এক আনন্দময় জীবন? কবি কি তবে নিয়তিবিদ্ধ? কবিই কি কেবল, অন্যরা নন? এসব গোলকধাঁধার মানে কী? সত্যিই কি গোলকধাঁধা এক নাকি চিন্তার অস্পষ্টতা, অলৌকিকতার আরাম? জুয়েল মোস্তাফিজের ‘ভাতের ভূগোল’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থ পড়তে পড়তে এমন এক ভাবনাঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে হলো।
শিল্পের কাছে, সুতরাং কবিতার কাছেও, মনে হয় মানুষের মৌলিক প্রত্যাশা-প্রত্য বা পরোভাবে জীবনযাপনের অনুপ্রেরণা। এ বিনিময় যেন জলের ওপর জলে আঁকা ছবি। হয়তো দৃশ্যমান নয়, কিন্তু অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যৎসামান্য পত্র-বিনিময়ে কবিতায় প্রশান্তি ও প্রদাহের ভূমিকা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল, প্রলম্বিত হতে পারেনি। হলে আমাদের উপকার হতো। আমাদের নন্দনচিন্তায় ভাবালুতাবর্জিত ঋজুতা যথোচিত মর্যাদা লাভ করতে পারত। আমাদের জীবনবাস্তবতায় আলো আছে, অন্ধকারও আছে। দিন আছে, রাতও। কিন্তু দিন ও রাতের আয়তন সাধারণত সমান হয় না। ঘন-আঠাল জান্তব অন্ধকারের বিস্তার ঘটলে আলো সংকুচিত হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক ব্যভিচারিতা, রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাচার, সামাজিক ঘূর্ণাবর্তে সৃষ্ট কলুষ তথা সভ্যতা-উপজাত অস্থিরতা ব্যক্তির জীবন থেকে হরণ করে নেয় প্রসন্নতার বোধ। সেই সমাজস্থিত মানুষ হিসেবে সুবেদী চিত্তের কবির মানসিক অবস্থা হয়ে ওঠে মর্মান্তিক। এমন কলুষিত অন্ধকারে জৈবিক অস্তিত্ব রার জন্য প্রাথমিক আয়ুধই হলো অন্ন। ভাত। প্রকৃত অর্থেই প্রথম মানবিক মৌলিক অধিকার। কিন্তু এ অধিকার তার অনায়ত্ত। সুদূর। বেদনাবিধুর। স্বেদে-রক্তে-অশ্রুতে সিক্ত এ মৌলিক চাহিদা। আর এ আর্ততার বোধ প্তি-ক্রুদ্ধ-মত্ত করে তুলেছে কবি জুয়েল মোস্তাফিজকে। তাঁর শিল্পচৈতন্যের প্রাণপঙ্ক হয়ে উঠেছে 'ভাত'। ভাত জুয়েলের কবিতায় জীবনযাপনের উপকরণ নয় নিছক, সে নিজেই হয়ে উঠেছে চরিত্র-সহচরিত্র-অনুচরিত্র-প্রকৃতি ও পরিপার্শ্ব। ভাত দর্শক ও দ্রষ্টা, সৃষ্টি ও স্রষ্টা, সুস্থিত ও অস্থির। জুয়েলের দুটি ভাত চোখ-বদল করে। প্রেণবিন্দু বদলে বদলে দেখে পরস্পরকে এবং পরিপার্শ্বকে। সব কিছুই তাই চলে আসে ভাতের দৃষ্টির সীমানায়। জুয়েলের ভাতের চোখে আলো প্রজ্বলিত করে ভূগর্ভস্থ অগ্নি। এই জ্বলন-প্রতিভা, এই দহন-মহিমা তাড়িয়ে বেড়ায় কবিকে। তিনি অনুভব করেন, 'একটি ভাতের ভেতর থেকে গেল মহাকালের না বলা কথার ভার'। ভাত তাই বাঙ্ময়। সে জানায় কেন্দ্র-বিচ্যুত ব্রহ্মাণ্ড-পরিভ্রমণের সাতকাহন। কাল থেকে কালান্তরের ইতিবৃত্ত। মাড়ান থেকে গোলাঘর, গোলাঘর থেকে তার অনন্তযাত্রা, 'ভাতের আয়ুর কাণ্ড বেড়ে যায়, চলে যায় অনন্তের দিকে।' ভাতের প্রার্থনা, 'মানব-অন্তর যেন তাদের এক অন্তরে রাখে।' কেননা জুয়েল আমাদের জানিয়েছেন, 'যে তুমি মানব-অন্তর খেয়েছ এক থালা ভাত তুমিই সর্বজ্ঞানী।' সত্যি, অন্নচিন্তা চমৎকার!
জীব ও প্রাণীমাত্রই ক্ষুণ্নিবৃত্তির প্রচেষ্টায় আত্মসমর্পিত। অতএব মানুষও। মানুষ সভ্যতার নির্মাতা, সুতরাং নির্ণায়ক। ক্ষুধা কি তবে মানুষের নিহিত-সামর্থ্যের উদ্বোধক? আর ভাত চালিকাশক্তি? যেখানে মানুষ, সেখানে ক্ষুধা, ভাত সুধা। যেখানে ভাত সেখানে দ্বন্দ্ব, ছন্দপতন। সেখানে লড়াই, রক্তপাত, জয়-পরাজয়। এরই পুনরাবৃত্তি। প্রাচীন গুহাচিত্রে শিকার-যাত্রার আয়োজন, অগ্নি জ্বেলে বৃত্তাকার সমবেত নৃত্য ক্ষুধা আর ভাতেরই প্রত্নপ্রতিমা। কোথায় নেই এ আকাঙ্ক্ষা ও আর্তনাদ?
'চর্যাপদে'ও নিরন্নের হাহাকার ধ্বনিত হয়েছে :
টালত মোর ঘর নাহি পড়বেসী।
হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী।
ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা-অধ্যুষিত মধ্যযুগের আখ্যায়িকা কাব্যসমূহে, মঙ্গলকাব্যের 'বারমাস্যা' বা 'সতী নারীর পতি নিন্দায়' ভাতের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে বারংবার। আর কেউ কি ভুলতে পারে ঈশ্বরী পাটিনীর সেই চিত্তস্পর্শী প্রার্থনা, 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে'? বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় ভাতের প্রসঙ্গ এসেছে উপর্যুপরি, করুণাকাতর আবহে, উৎকণ্ঠায় বা প্রত্যাশায় :
আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে/কারা যেন আজো ভাত রাঁধে/ভাত বাড়ে, ভাত খায়/আর আমরা সারারাত জেগে থাকি/আশ্চর্য ভাতের গন্ধে,/প্রার্থনায়,/সারারাত।
['আশ্চর্য ভাতের গন্ধ', মুখে যদি রক্ত ওঠে]
চিত্রে-চলচ্চিত্রে-আলোকচিত্রে-গণসংগীতে-নাটকে-কথাসাহিত্যে, অর্থাৎ শিল্পের প্রায় সব আঙ্গিকে ভাতের প্রসঙ্গ উপস্থিত। রফিক আজাদের 'ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো'র হুঙ্কার এখনো মিলিয়ে যায়নি। তা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে জুয়েলের কাব্যচৈতন্যে ভাত যে জায়গাটি দখল করেছে, তা অভিনব, অনন্য। কিন্তু তা তাঁর আত্মা ও সত্তাকে শোষণ করেই বেড়ে ওঠা। এর মধ্যে কোনো আকস্মিকতা নেই, চটকদারিত্বও নেই। এমন বস্তুনিষ্ঠ বিষয় নিয়ে রচনা স্লোগান হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকেথতা থেকেও এ মুক্ত। প্রবেশপথের কবিতাটি বাদ দিলে, ৫০টি খণ্ড কবিতায় জুয়েল যে আখ্যান রচনা করেছেন, এর পটভূমিগত বিস্তার, বিচূর্ণিত কালধারণা, দার্শনিক সমুন্নতি এবং কলা প্রসাধন একটি মহাকাব্যিক আবহই যেন নির্মাণ করতে চায়। সাবলীল এক ভাষাস্রোত আমাদের ভুলিয়ে দেয় পুরো কাব্য টানা গদ্যে লেখা। ঘটনার বা অনুভূতির বা চিন্তার বা আবহের অনুরোধে তাঁর গদ্যভাষ্যে উচ্চাবচতা তৈরি হয়েছে, কিন্তু কোথাও তা আড়ষ্ট হয়ে পড়েনি। এ কারণেই দেখি কোথাও তা নির্মাণ করে এক পরাবাস্তবিক বাতাবরণ :
কারণ কোনো এক জনমে ভাতগুলো ক্ষুধা খেয়ে বাঁচত, কারণ এ জনমে ক্ষুধাগুলো ভাত খেয়ে বাঁচে? আরো একটা ব্যাপারথযে ভাতটি উড়ত, সে ভাতের শরীর ভরেছিল কেবলই পাখা আর যে ভাতটি দেখত, সে ভাতের পুরো দেহটায় ছিল চোখ, কিংবা মুখওয়ালা ভাতগুলো দেহভরা মুখের কল্যাণে ভেবেছিল কিভাবে মৃত্যুগুলো খেয়ে ফেলা যায়। তাই তো একদিন ভাতের চাক ভেঙে গিয়েছিল আর ভাতের চাক ভেঙে যতসব ক্ষুধাবৃক্ষরে মধুথসবই খেয়েছিল মহাকালের মুখ।
(পাঁচ)
কখনো কখনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সর্বপ্রাণবাদ :
আমরা কখনোই জানতাম না সূর্যের ঘুম আছে, তাপর সূর্যের স্বপ্নের ভেতর লাল ফড়িং হয়ে উড়েছি সহস্রকাল। আমরা কখনোই জানতাম না মাটির রক্ত আছে, তাই তো সেই আকর্ষণে নেমে এসেছি মাটির জঠরে।
(ছয়)
দেখা যায়, পারসোনিফিকেশনের প্রবণতাটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে কবি জুয়েল মোস্তাফিজের 'ভাতের ভূগোলে', 'ঘামগুলোকে জোনাকি হতে দেখেছি। পাখিগুলো এবার ভাতগুলোকে তাদের কণ্ঠনালীতে বাঁধল আর অমনি পাখির ক্ষুধাগুলো ভাতের ভেতর হয়ে গেল জোনাকি'।
(সাত)
জুয়েলের কল্পনাশক্তির প্রাখর্য ও গাম্ভীর্য বিস্ময়কর। মনে হয়, যুক্তিকে নির্বাসন দিয়ে এক বিশালায়তন কাব্যসাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে 'ভাতের ভূগোলে', 'মৃত মানুষের স্বপ্নের ভেতর আমাদের সাপ হতে হবে, ব্যাঙ হতে হবে। তোমরা কি এই হাঁড়ির ভেতর থেকে দেখতে পাচ্ছ মৃত মানুষের নিঃশ্বাস?' (আট) বা, যখন তিনি বলেন, 'ভাতগুলো ভুলতে পারে না তারা মশা ছিল, ভাতগুলো কখনো ভুলে যায় না পাহাড়ের পাদদেশে তারা কয়লারূপে বেঁচে ছিল বহুকাল। (নয়) কিন্তু যুক্তিমুক্ত কল্পনার বিবেচনা প্রশ্নের মুখোমুখি হয় যখন উদ্বাস্তুদের ভাতের হাহাকার মূর্ত হতে দেখি 'ভাতের ভূগোলে' : 'আর বহুকাল না খেয়ে খেয়ে একদিন যখন নিতাই কাকা স্বপ্নের ভেতর অনেক ভাত খেল, তখন স্বপ্নের ভেতর ভাসমান ভাতগুলো নিতাই কাকাকে বলেছিল থজানো, উদ্বাস্তুদের কোনো মানচিত্র নেই, উদ্বাস্তুদের মানচিত্রের রেখাগুলো কেটে কেটে কেটে কেটে বানানো হয়েছে পৃথিবীর সমস্ত জুতোর ফিতা'।
বলেছি, ভাত কেবল উপাদান বা উপকরণ নয়, ভাত চরিত্র জুয়েল মোস্তাফিজের এ কাব্যে। কিন্তু একটি মাত্র চরিত্রেই স্থিত নয় সে। ক্রমাগত বিবর্তমান, রূপারূপে যাতায়াত-প্রবণ, অঘটন-পটু, সর্বত্রগামীথকিন্তু কখনোই অস্পষ্ট নয়, কখনোই নমিত নয়, কুণ্ঠিত নয়। চরিত্রগত গমনাগমনে কখনো সে হয়ে ওঠে ক্রুশবিদ্ধ যিশু, (ভাত! তুমি কি এই দেহের আঁতুড়ঘরে রৈপটে থাকা আজন্ম শিশু, তুমিই কি প্রাণের ওপর আটকে আছ ক্রুশবিদ্ধ যিশু...), আবার কখনো ভাত এমন একটি রূপক, যার মধ্য দিয়ে কবি অনুসন্ধান করেন মহাবিশ্বের রহস্য, 'আর এভাবেই ভাতের গা-গতর দেখে জানা গিয়েছিল কাল মহাকাল ঘুরে এসে থালার ওপর ভেঙেছিল ঈশ্বরের ডানা। তোমরা কি ভেবেছ ভাতগুলো দৌড় জানে না? নিশ্চয় ভাতগুলো শূন্য চাকার মতো দৌড়ে আসে আমাদের থালায়। আর আমরা প্রত্যেকে মহাশূন্য হয়ে উঠি।' এই স্বরায়ন আমাদের ধর্মগ্রন্থের উচ্চারণভঙ্গিকে মনে করিয়ে দেয়। সম্ভবত ঈশ্বর ও মহাবিশ্বের বিশালতার টানে শব্দ ও সুর এ স্বভাবকে আত্তীকৃত করে নিয়েছে। প্রাচ্যের ভাত-বন্দনা (তাই তো প্রাচ্যের পাগুলো এত করুণ। বিশ্বাস করুন, এই অনাহূত প্রাচ্যের একমাত্র ঈশ্বরের নাম ভাত) সব সীমান্ত ডিঙিয়ে দেশোত্তর তথা সর্ব-পরিব্যাপ্ত হয়েই দেখা দিয়েছে 'ভাতের ভূগোলে'। বিমিশ্র পুরাণানুষঙ্গ ব্যবহৃত হয়েছে 'ভাতের ভূগোলে' :
১. জীবনমুখে ফুটল কত গন্ধমের ফুল।
২. প্রাণের অর্জুন এ জীবনে তুমি কি জেনেছিলে ঈশ্বরের প্রাণে লেগেছে ভাতের পোকা?
লোকজ আখ্যান, আবহ ও সুরের প্রয়োগনৈপুণ্য মনোযোগ আকর্ষণ করে। ভাষাপ্রবাহের সচ্ছলতার কথা আগেই বলেছি। উপমা-রূপক-চিত্রকল্প নির্মাণেও জুয়েল মোস্তাফিজ বেশ কুশলী। চেনা শব্দকে অচেনার অভিনবত্বে যোজনার সামর্থ্য প্রশংসনীয়। তিনি যখন আমাদের জানিয়ে দেন 'আর আমাদের থালার ওপর প্রতিটি ভাতের অভিজ্ঞান আলাদা আলাদা', তখন মনে হয়, কবি জুয়েল মোস্তাফিজের এ কাব্যভাষা বিষয়ানুগ, স্বচ্ছন্দ ও প্রশংসনীয়। বিমিশ্র এক নন্দনতত্ত্বের ফসল যেন এ কাব্য। সমন্বিত যদি নাও হয়ে থাকে, সমুন্নত বটে। বহুবিধ বৈশিষ্ট্যে স্বকীয় ও উজ্জ্বল। প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'জুয়ার আসরে কোনো আঙুলই মিথ্যা নয়' দিয়ে একটি কাব্যঘোরই তৈরি করেছিলেন কবি জুয়েল মোস্তাফিজ। 'ভাতের ভূগোল' এক অদ্ভুত জাগরণ। না, কেবলই প্রদাহ নয়, প্রশান্তিও ছড়িয়ে আছে বিশাল এ ভূগোলে। এই পরিপূরকতা পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় মনে হবে। আমরা তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থের পথ চেয়ে থাকলাম।
প্রকাশের সময় ২৭ আগস্ট, শিলালিপি কালের কণ্ঠ
ভাতের ভূগোল বইটি ডাউনলোড করুন।
সত্যি কি কবি নিজের জোরে মাতাল নাকি অন্য কেউ মাতিয়ে তোলে তাঁকে? লৌকিক বা অলৌকিক কোনো শক্তি বা অন্য কিছু? জীবনে দুঃখ যেমন সত্য, আনন্দ-উৎসবও তো তাই। তবু কেন কবি বলেন, ‘উৎসবের কথা আমি কহি নাকো?’শেলী কেন বলেন, ‘আমাদের মধুরতম সংগীত সেইগুলো, যেখানে বর্ণিত হয়েছে দুঃখানুভূতি?’ কেন রবীন্দ্রনাথের মনে হয়, ‘অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেন/ তার বে বেদনা অপার?’ কবি তবে বেদনারই মানসপুত্র? কবি যদি বেদনার মানসপুত্র বা কন্যা, তবে তিনি কেন ইস্তফা দিয়ে বেছে নেন না অন্য এক আনন্দময় জীবন? কবি কি তবে নিয়তিবিদ্ধ? কবিই কি কেবল, অন্যরা নন? এসব গোলকধাঁধার মানে কী? সত্যিই কি গোলকধাঁধা এক নাকি চিন্তার অস্পষ্টতা, অলৌকিকতার আরাম? জুয়েল মোস্তাফিজের ‘ভাতের ভূগোল’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থ পড়তে পড়তে এমন এক ভাবনাঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে হলো।
শিল্পের কাছে, সুতরাং কবিতার কাছেও, মনে হয় মানুষের মৌলিক প্রত্যাশা-প্রত্য বা পরোভাবে জীবনযাপনের অনুপ্রেরণা। এ বিনিময় যেন জলের ওপর জলে আঁকা ছবি। হয়তো দৃশ্যমান নয়, কিন্তু অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যৎসামান্য পত্র-বিনিময়ে কবিতায় প্রশান্তি ও প্রদাহের ভূমিকা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল, প্রলম্বিত হতে পারেনি। হলে আমাদের উপকার হতো। আমাদের নন্দনচিন্তায় ভাবালুতাবর্জিত ঋজুতা যথোচিত মর্যাদা লাভ করতে পারত। আমাদের জীবনবাস্তবতায় আলো আছে, অন্ধকারও আছে। দিন আছে, রাতও। কিন্তু দিন ও রাতের আয়তন সাধারণত সমান হয় না। ঘন-আঠাল জান্তব অন্ধকারের বিস্তার ঘটলে আলো সংকুচিত হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক ব্যভিচারিতা, রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাচার, সামাজিক ঘূর্ণাবর্তে সৃষ্ট কলুষ তথা সভ্যতা-উপজাত অস্থিরতা ব্যক্তির জীবন থেকে হরণ করে নেয় প্রসন্নতার বোধ। সেই সমাজস্থিত মানুষ হিসেবে সুবেদী চিত্তের কবির মানসিক অবস্থা হয়ে ওঠে মর্মান্তিক। এমন কলুষিত অন্ধকারে জৈবিক অস্তিত্ব রার জন্য প্রাথমিক আয়ুধই হলো অন্ন। ভাত। প্রকৃত অর্থেই প্রথম মানবিক মৌলিক অধিকার। কিন্তু এ অধিকার তার অনায়ত্ত। সুদূর। বেদনাবিধুর। স্বেদে-রক্তে-অশ্রুতে সিক্ত এ মৌলিক চাহিদা। আর এ আর্ততার বোধ প্তি-ক্রুদ্ধ-মত্ত করে তুলেছে কবি জুয়েল মোস্তাফিজকে। তাঁর শিল্পচৈতন্যের প্রাণপঙ্ক হয়ে উঠেছে 'ভাত'। ভাত জুয়েলের কবিতায় জীবনযাপনের উপকরণ নয় নিছক, সে নিজেই হয়ে উঠেছে চরিত্র-সহচরিত্র-অনুচরিত্র-প্রকৃতি ও পরিপার্শ্ব। ভাত দর্শক ও দ্রষ্টা, সৃষ্টি ও স্রষ্টা, সুস্থিত ও অস্থির। জুয়েলের দুটি ভাত চোখ-বদল করে। প্রেণবিন্দু বদলে বদলে দেখে পরস্পরকে এবং পরিপার্শ্বকে। সব কিছুই তাই চলে আসে ভাতের দৃষ্টির সীমানায়। জুয়েলের ভাতের চোখে আলো প্রজ্বলিত করে ভূগর্ভস্থ অগ্নি। এই জ্বলন-প্রতিভা, এই দহন-মহিমা তাড়িয়ে বেড়ায় কবিকে। তিনি অনুভব করেন, 'একটি ভাতের ভেতর থেকে গেল মহাকালের না বলা কথার ভার'। ভাত তাই বাঙ্ময়। সে জানায় কেন্দ্র-বিচ্যুত ব্রহ্মাণ্ড-পরিভ্রমণের সাতকাহন। কাল থেকে কালান্তরের ইতিবৃত্ত। মাড়ান থেকে গোলাঘর, গোলাঘর থেকে তার অনন্তযাত্রা, 'ভাতের আয়ুর কাণ্ড বেড়ে যায়, চলে যায় অনন্তের দিকে।' ভাতের প্রার্থনা, 'মানব-অন্তর যেন তাদের এক অন্তরে রাখে।' কেননা জুয়েল আমাদের জানিয়েছেন, 'যে তুমি মানব-অন্তর খেয়েছ এক থালা ভাত তুমিই সর্বজ্ঞানী।' সত্যি, অন্নচিন্তা চমৎকার!
জীব ও প্রাণীমাত্রই ক্ষুণ্নিবৃত্তির প্রচেষ্টায় আত্মসমর্পিত। অতএব মানুষও। মানুষ সভ্যতার নির্মাতা, সুতরাং নির্ণায়ক। ক্ষুধা কি তবে মানুষের নিহিত-সামর্থ্যের উদ্বোধক? আর ভাত চালিকাশক্তি? যেখানে মানুষ, সেখানে ক্ষুধা, ভাত সুধা। যেখানে ভাত সেখানে দ্বন্দ্ব, ছন্দপতন। সেখানে লড়াই, রক্তপাত, জয়-পরাজয়। এরই পুনরাবৃত্তি। প্রাচীন গুহাচিত্রে শিকার-যাত্রার আয়োজন, অগ্নি জ্বেলে বৃত্তাকার সমবেত নৃত্য ক্ষুধা আর ভাতেরই প্রত্নপ্রতিমা। কোথায় নেই এ আকাঙ্ক্ষা ও আর্তনাদ?
'চর্যাপদে'ও নিরন্নের হাহাকার ধ্বনিত হয়েছে :
টালত মোর ঘর নাহি পড়বেসী।
হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী।
ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা-অধ্যুষিত মধ্যযুগের আখ্যায়িকা কাব্যসমূহে, মঙ্গলকাব্যের 'বারমাস্যা' বা 'সতী নারীর পতি নিন্দায়' ভাতের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে বারংবার। আর কেউ কি ভুলতে পারে ঈশ্বরী পাটিনীর সেই চিত্তস্পর্শী প্রার্থনা, 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে'? বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় ভাতের প্রসঙ্গ এসেছে উপর্যুপরি, করুণাকাতর আবহে, উৎকণ্ঠায় বা প্রত্যাশায় :
আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে/কারা যেন আজো ভাত রাঁধে/ভাত বাড়ে, ভাত খায়/আর আমরা সারারাত জেগে থাকি/আশ্চর্য ভাতের গন্ধে,/প্রার্থনায়,/সারারাত।
['আশ্চর্য ভাতের গন্ধ', মুখে যদি রক্ত ওঠে]
চিত্রে-চলচ্চিত্রে-আলোকচিত্রে-গণসংগীতে-নাটকে-কথাসাহিত্যে, অর্থাৎ শিল্পের প্রায় সব আঙ্গিকে ভাতের প্রসঙ্গ উপস্থিত। রফিক আজাদের 'ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো'র হুঙ্কার এখনো মিলিয়ে যায়নি। তা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে জুয়েলের কাব্যচৈতন্যে ভাত যে জায়গাটি দখল করেছে, তা অভিনব, অনন্য। কিন্তু তা তাঁর আত্মা ও সত্তাকে শোষণ করেই বেড়ে ওঠা। এর মধ্যে কোনো আকস্মিকতা নেই, চটকদারিত্বও নেই। এমন বস্তুনিষ্ঠ বিষয় নিয়ে রচনা স্লোগান হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকেথতা থেকেও এ মুক্ত। প্রবেশপথের কবিতাটি বাদ দিলে, ৫০টি খণ্ড কবিতায় জুয়েল যে আখ্যান রচনা করেছেন, এর পটভূমিগত বিস্তার, বিচূর্ণিত কালধারণা, দার্শনিক সমুন্নতি এবং কলা প্রসাধন একটি মহাকাব্যিক আবহই যেন নির্মাণ করতে চায়। সাবলীল এক ভাষাস্রোত আমাদের ভুলিয়ে দেয় পুরো কাব্য টানা গদ্যে লেখা। ঘটনার বা অনুভূতির বা চিন্তার বা আবহের অনুরোধে তাঁর গদ্যভাষ্যে উচ্চাবচতা তৈরি হয়েছে, কিন্তু কোথাও তা আড়ষ্ট হয়ে পড়েনি। এ কারণেই দেখি কোথাও তা নির্মাণ করে এক পরাবাস্তবিক বাতাবরণ :
কারণ কোনো এক জনমে ভাতগুলো ক্ষুধা খেয়ে বাঁচত, কারণ এ জনমে ক্ষুধাগুলো ভাত খেয়ে বাঁচে? আরো একটা ব্যাপারথযে ভাতটি উড়ত, সে ভাতের শরীর ভরেছিল কেবলই পাখা আর যে ভাতটি দেখত, সে ভাতের পুরো দেহটায় ছিল চোখ, কিংবা মুখওয়ালা ভাতগুলো দেহভরা মুখের কল্যাণে ভেবেছিল কিভাবে মৃত্যুগুলো খেয়ে ফেলা যায়। তাই তো একদিন ভাতের চাক ভেঙে গিয়েছিল আর ভাতের চাক ভেঙে যতসব ক্ষুধাবৃক্ষরে মধুথসবই খেয়েছিল মহাকালের মুখ।
(পাঁচ)
কখনো কখনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সর্বপ্রাণবাদ :
আমরা কখনোই জানতাম না সূর্যের ঘুম আছে, তাপর সূর্যের স্বপ্নের ভেতর লাল ফড়িং হয়ে উড়েছি সহস্রকাল। আমরা কখনোই জানতাম না মাটির রক্ত আছে, তাই তো সেই আকর্ষণে নেমে এসেছি মাটির জঠরে।
(ছয়)
দেখা যায়, পারসোনিফিকেশনের প্রবণতাটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে কবি জুয়েল মোস্তাফিজের 'ভাতের ভূগোলে', 'ঘামগুলোকে জোনাকি হতে দেখেছি। পাখিগুলো এবার ভাতগুলোকে তাদের কণ্ঠনালীতে বাঁধল আর অমনি পাখির ক্ষুধাগুলো ভাতের ভেতর হয়ে গেল জোনাকি'।
(সাত)
জুয়েলের কল্পনাশক্তির প্রাখর্য ও গাম্ভীর্য বিস্ময়কর। মনে হয়, যুক্তিকে নির্বাসন দিয়ে এক বিশালায়তন কাব্যসাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে 'ভাতের ভূগোলে', 'মৃত মানুষের স্বপ্নের ভেতর আমাদের সাপ হতে হবে, ব্যাঙ হতে হবে। তোমরা কি এই হাঁড়ির ভেতর থেকে দেখতে পাচ্ছ মৃত মানুষের নিঃশ্বাস?' (আট) বা, যখন তিনি বলেন, 'ভাতগুলো ভুলতে পারে না তারা মশা ছিল, ভাতগুলো কখনো ভুলে যায় না পাহাড়ের পাদদেশে তারা কয়লারূপে বেঁচে ছিল বহুকাল। (নয়) কিন্তু যুক্তিমুক্ত কল্পনার বিবেচনা প্রশ্নের মুখোমুখি হয় যখন উদ্বাস্তুদের ভাতের হাহাকার মূর্ত হতে দেখি 'ভাতের ভূগোলে' : 'আর বহুকাল না খেয়ে খেয়ে একদিন যখন নিতাই কাকা স্বপ্নের ভেতর অনেক ভাত খেল, তখন স্বপ্নের ভেতর ভাসমান ভাতগুলো নিতাই কাকাকে বলেছিল থজানো, উদ্বাস্তুদের কোনো মানচিত্র নেই, উদ্বাস্তুদের মানচিত্রের রেখাগুলো কেটে কেটে কেটে কেটে বানানো হয়েছে পৃথিবীর সমস্ত জুতোর ফিতা'।
বলেছি, ভাত কেবল উপাদান বা উপকরণ নয়, ভাত চরিত্র জুয়েল মোস্তাফিজের এ কাব্যে। কিন্তু একটি মাত্র চরিত্রেই স্থিত নয় সে। ক্রমাগত বিবর্তমান, রূপারূপে যাতায়াত-প্রবণ, অঘটন-পটু, সর্বত্রগামীথকিন্তু কখনোই অস্পষ্ট নয়, কখনোই নমিত নয়, কুণ্ঠিত নয়। চরিত্রগত গমনাগমনে কখনো সে হয়ে ওঠে ক্রুশবিদ্ধ যিশু, (ভাত! তুমি কি এই দেহের আঁতুড়ঘরে রৈপটে থাকা আজন্ম শিশু, তুমিই কি প্রাণের ওপর আটকে আছ ক্রুশবিদ্ধ যিশু...), আবার কখনো ভাত এমন একটি রূপক, যার মধ্য দিয়ে কবি অনুসন্ধান করেন মহাবিশ্বের রহস্য, 'আর এভাবেই ভাতের গা-গতর দেখে জানা গিয়েছিল কাল মহাকাল ঘুরে এসে থালার ওপর ভেঙেছিল ঈশ্বরের ডানা। তোমরা কি ভেবেছ ভাতগুলো দৌড় জানে না? নিশ্চয় ভাতগুলো শূন্য চাকার মতো দৌড়ে আসে আমাদের থালায়। আর আমরা প্রত্যেকে মহাশূন্য হয়ে উঠি।' এই স্বরায়ন আমাদের ধর্মগ্রন্থের উচ্চারণভঙ্গিকে মনে করিয়ে দেয়। সম্ভবত ঈশ্বর ও মহাবিশ্বের বিশালতার টানে শব্দ ও সুর এ স্বভাবকে আত্তীকৃত করে নিয়েছে। প্রাচ্যের ভাত-বন্দনা (তাই তো প্রাচ্যের পাগুলো এত করুণ। বিশ্বাস করুন, এই অনাহূত প্রাচ্যের একমাত্র ঈশ্বরের নাম ভাত) সব সীমান্ত ডিঙিয়ে দেশোত্তর তথা সর্ব-পরিব্যাপ্ত হয়েই দেখা দিয়েছে 'ভাতের ভূগোলে'। বিমিশ্র পুরাণানুষঙ্গ ব্যবহৃত হয়েছে 'ভাতের ভূগোলে' :
১. জীবনমুখে ফুটল কত গন্ধমের ফুল।
২. প্রাণের অর্জুন এ জীবনে তুমি কি জেনেছিলে ঈশ্বরের প্রাণে লেগেছে ভাতের পোকা?
লোকজ আখ্যান, আবহ ও সুরের প্রয়োগনৈপুণ্য মনোযোগ আকর্ষণ করে। ভাষাপ্রবাহের সচ্ছলতার কথা আগেই বলেছি। উপমা-রূপক-চিত্রকল্প নির্মাণেও জুয়েল মোস্তাফিজ বেশ কুশলী। চেনা শব্দকে অচেনার অভিনবত্বে যোজনার সামর্থ্য প্রশংসনীয়। তিনি যখন আমাদের জানিয়ে দেন 'আর আমাদের থালার ওপর প্রতিটি ভাতের অভিজ্ঞান আলাদা আলাদা', তখন মনে হয়, কবি জুয়েল মোস্তাফিজের এ কাব্যভাষা বিষয়ানুগ, স্বচ্ছন্দ ও প্রশংসনীয়। বিমিশ্র এক নন্দনতত্ত্বের ফসল যেন এ কাব্য। সমন্বিত যদি নাও হয়ে থাকে, সমুন্নত বটে। বহুবিধ বৈশিষ্ট্যে স্বকীয় ও উজ্জ্বল। প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'জুয়ার আসরে কোনো আঙুলই মিথ্যা নয়' দিয়ে একটি কাব্যঘোরই তৈরি করেছিলেন কবি জুয়েল মোস্তাফিজ। 'ভাতের ভূগোল' এক অদ্ভুত জাগরণ। না, কেবলই প্রদাহ নয়, প্রশান্তিও ছড়িয়ে আছে বিশাল এ ভূগোলে। এই পরিপূরকতা পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় মনে হবে। আমরা তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থের পথ চেয়ে থাকলাম।
প্রকাশের সময় ২৭ আগস্ট, শিলালিপি কালের কণ্ঠ
ভাতের ভূগোল বইটি ডাউনলোড করুন।