ইমরুল হাসান
লালঘর। ইচক দুয়েন্দে। বাঙলায়ন। ফেব্রুয়ারি ২০১০। পৃষ্টা : ৬২। মূল্য: ১২৫ টাকা। প্রচ্ছদ: শিবু কুমার শীল।
‘পৃথিবীতে যে কারাগার নামে একটা জিনিস আছে, এ আমার জানাই ছিল না। বহুবার শুনেছিলাম। বর্ণনা শুনেছিলাম বহু মানুষের মুখ থেকে। বর্ণনাগুলি কি মনে রেখেছিলাম? এরকম একটা মর্মান্তিক জিনিস পৃথিবীতে আছে, সিরিয়াসলি তা নিয়ে কি ভেবেছিলাম?’ (পৃষ্টা-৫৯)
অনেকদিন পর রসাইয়া রসাইয়া একটা বই পড়লাম। ধীরে ধীরে, প্রতিটা শব্দ, বাক্য, ঘটনা দেখতে দেখতে... কী যে ভালো লাগলো!
আর আসলে ভক্তিভাব চইলা আসলে তো কথা বলা যায় না, নিরবতা চইলা আসে। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক এইরমও না। কোনো একটা নির্দিষ্ট ব্যাপার না যেইটা আকর্ষণ করছে, বরং এই ছোটখাট বইটার ভিতর অনেক জিনিস চোখে পড়ছে। সবচে’ বেশি যে জিনিসটা চোখে পড়ছে, ব্যক্তির সাথে সাথে, ঘটনার সাথে সাথে ভাষার ধরনটাও পাল্টাইতেছে... মনে হইছে যে জাগলিংটা উনি করলেন, এইরকমটা আর কোথাও কি দেখছি! খুবই অন্যরকম এই ঘটনা।
অথচ ঘটনা তো সাধারণ। একদল ভদ্রলোক (ছোট একটা সংজ্ঞাও তুলে দিলাম- নোট ১) মাল খাইতে গিয়া ধরা খাইছেন, তাদের একদিনের কারাগারবাসের গল্প। আর এই ঘটনা বলতে গিয়া লেখক ‘নাম’ নিয়া যা করলেন, সেইটা আরেক ঘটনা। এমনকি লেখক তাঁর নিজের নামও রাখছেন। একটা ‘নাম’ তো সাধারণ কোন ঘটনা না। রেড ইন্ডিয়ানরা যেমন ব্যক্তির নামকরণ করে, তার উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনা দিয়া - ড্যান্সিং উইথ ওলফস, লেডি উইথ এ ফিস্ট... এইখানে উনার নামকরণগুলিতে শ্রুতিমধুরতা আছে, কোন অর্থবোকতা সাধারণ অর্থে, একবারেই নাই... তবে কিছু জিনিস মনে হইছে; চিকচাক রুই, একটা নেতা-গোছের নাম, ইমুস ক্যাটস, পাশ্চাত্য-দর্শনে আসক্ত... আবার, আগা আবদুর রহমান, নিতান্ত-ই একজন সান্ত্রী, শুধু টুকটাক লিখেন বইলা ‘আগা’ বিষয়টা সংযুক্ত হইছে, এইরম একটা একটা নাম হয়তো ব্যক্তি-বিশেষের প্রবণতার কথা বলে... কিন্তু এইরম নামকরণ এর অভিজ্ঞতা বাংলাভাষা কি আর কোনসময় নিছে?
বলতেছিলাম তাঁর ভাষার কথা, লেখক বা তাঁর চরিত্র যেইভাবে চিন্তা করে, ভাষার গঠন তো সেইভাবেই আসে... তবে ইদানিং ভাষা নিয়া যে বির্তক শুরু হইছে, এইটা দিয়াই আসলে টের পাওয়া যায়, চিন্তার অসহায়ত্ব কোন পর্যায়ে গিয়া পৌঁছাইলে, মানুষ কী বলা হইছে, তার দিকে নজর না দিয়া কীভাবে বলা হইতেছে, তার ওপর গিয়া হুমড়ি খাইয়া পড়ে... এই বির্তক বর্তমান বাংলাভাষায় চিন্তার অসারতার একটা চলমান উদাহারণ। আর এই দেখনদারির বিষয়টা তো আসলে একদিনে ঘটে নাই, ক্রমান্বয়ে আসছে... কিভাবে উচ্চারণটাই মুখ্য হয়া উঠলো, আমি শুনলাম তুমি কীভাবে বললা, কী বললা সেইটা আর মুখ্য না, কারণ তোমার তো বলার কিছুই নাই, ওই উচ্চারণটাই শুধু... যেমন কবিতা-লেখার চাইতে কবিতা-আবৃত্তি অনেকবেশি পপুলারিটি পাইলো... এইটা আলাদাভাবে দেখা গেল হয়তো খুব একটা খারাপ না, কিন্তু এইধরনের বিষয়গুলাই আসলে ট্রেন্ড সেট কইরা দিচ্ছে... তুমি যেইভাবে কথা বলো, বলতে চাও; সেইটারে আটকাইয়া দিয়া আমি তোমার চিন্তারেই কন্ট্রোল কইরা ফেলবো - ভাষার কারাগার (ব্যাকরণ) এ তোমারে ফেলে দিবো!
অন্যদিকে, ভাষা-ই কিন্তু চরিত্রগুলার ডেফিনেশন দিয়া দিতেছে... এই ভিন্নতাগুলি যদি আমরা আটকাইয়া ফেলি, তাইলে মানুষ হিসাবে তাদের চিন্তার ভিন্নতাগুলিরে আমরা কী কইরা প্রমাণ করবো?
আরেকটা জিনিস মনে হইছে, বাংলাদেশের গদ্যের মান যতোটা ম্যাচিউরড, কবিতা আসলে ততোটা হইতে পারে নাই। কারণ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক রে সাইডলাইনে বসাইয়া দিলেও উনাদের প্রভাব আটকাইয়া রাখা যায় নাই, যার ফলে উনাদের পরে বাংলাদেশে গদ্য লিখতে হইলে যে শক্তিটা লাগে সেইটা না থাকলে কোন গদ্যই আর হয় না। কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণের যে ধারাবাহিকতারে জোর কইরা প্রতিষ্ঠিত করা হইতেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে কবিতার কোন পাটাতনই দাঁড়াইতে পারে নাই... হয়তো কবিতার ব্যাপারটাও এইরমই, খুবই এবড়ো-খেবড়ো...
যা-ই হোক, কারাগার এর বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নগুলি খুব স্বাভাবিকভাবেই কাহিনির ভিতর দিয়া উঠে আসছে। ব্যক্তির অনিশ্চিয়তা, তার যোগাযোগ-ক্ষমতা, নৈতিকতা, রাষ্ট্র ও মিডিয়া... রাজনৈতিক নেতারা তো অনেকেই ছিলেন কারাগারে, উনারা কেন এইটা বন্ধ করলেন না? কেন এই চোর-পুলিশ খেলা চলতেই থাকবে? চরিত্রগুলিই এই কথাগুলি বলছে, আলাদা কইরা লেখকরে বলা লাগে নাই; যদিও একটা গোছানো ফর্ম এর ভিতর দিয়াই প্রসঙ্গগুলি আসছে, কোনকিছুই ইমপোজড মনে হয় নাই, মনে হইছে লেখক বিষয়টা ঠিক কইরা রিলেভেন্ট সবকিছুরে একত্রিত করছেন...
আমার পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে যদ্দূর মনে হইছে, সাহিত্যে ‘কারাগার’ মূলত আসছে রাজবন্দীর রোজনামচা অথবা প্রিজন নোট এর মতো, যেইখানে গেলে ‘চিন্তা’ করার সময় পাওয়া যায়, ক্রিয়েটিভ থিকিং আসে... কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলে এইরম রোমান্টিক? সেইটা যে না, তা বলার মতো অন্তত একটা বই পাওয়া গেলো।
আমার বইটা পড়ে ভালো লাগছে আর মনে হইছে ভালোটা স্পষ্ট কইরা বলাটাও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
নোট ১:
‘ভদ্রলোকের কথাটা শুনে মনে মনে পস্তালাম। ঠিক, একদল ফিজিক্যালি ও মেন্টালি আনফিট লোকের মধ্যে আমি পড়ে গেছি। এরা বড্ড বকতে ভালবাসে, কিন্তু কোনো অ্যাকশন পছন্দ করে না।’ (পৃষ্টা - ২৮)
মার্চ ১৩, ২০১০
লালঘর। ইচক দুয়েন্দে। বাঙলায়ন। ফেব্রুয়ারি ২০১০। পৃষ্টা : ৬২। মূল্য: ১২৫ টাকা। প্রচ্ছদ: শিবু কুমার শীল।
‘পৃথিবীতে যে কারাগার নামে একটা জিনিস আছে, এ আমার জানাই ছিল না। বহুবার শুনেছিলাম। বর্ণনা শুনেছিলাম বহু মানুষের মুখ থেকে। বর্ণনাগুলি কি মনে রেখেছিলাম? এরকম একটা মর্মান্তিক জিনিস পৃথিবীতে আছে, সিরিয়াসলি তা নিয়ে কি ভেবেছিলাম?’ (পৃষ্টা-৫৯)
অনেকদিন পর রসাইয়া রসাইয়া একটা বই পড়লাম। ধীরে ধীরে, প্রতিটা শব্দ, বাক্য, ঘটনা দেখতে দেখতে... কী যে ভালো লাগলো!
আর আসলে ভক্তিভাব চইলা আসলে তো কথা বলা যায় না, নিরবতা চইলা আসে। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক এইরমও না। কোনো একটা নির্দিষ্ট ব্যাপার না যেইটা আকর্ষণ করছে, বরং এই ছোটখাট বইটার ভিতর অনেক জিনিস চোখে পড়ছে। সবচে’ বেশি যে জিনিসটা চোখে পড়ছে, ব্যক্তির সাথে সাথে, ঘটনার সাথে সাথে ভাষার ধরনটাও পাল্টাইতেছে... মনে হইছে যে জাগলিংটা উনি করলেন, এইরকমটা আর কোথাও কি দেখছি! খুবই অন্যরকম এই ঘটনা।
অথচ ঘটনা তো সাধারণ। একদল ভদ্রলোক (ছোট একটা সংজ্ঞাও তুলে দিলাম- নোট ১) মাল খাইতে গিয়া ধরা খাইছেন, তাদের একদিনের কারাগারবাসের গল্প। আর এই ঘটনা বলতে গিয়া লেখক ‘নাম’ নিয়া যা করলেন, সেইটা আরেক ঘটনা। এমনকি লেখক তাঁর নিজের নামও রাখছেন। একটা ‘নাম’ তো সাধারণ কোন ঘটনা না। রেড ইন্ডিয়ানরা যেমন ব্যক্তির নামকরণ করে, তার উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনা দিয়া - ড্যান্সিং উইথ ওলফস, লেডি উইথ এ ফিস্ট... এইখানে উনার নামকরণগুলিতে শ্রুতিমধুরতা আছে, কোন অর্থবোকতা সাধারণ অর্থে, একবারেই নাই... তবে কিছু জিনিস মনে হইছে; চিকচাক রুই, একটা নেতা-গোছের নাম, ইমুস ক্যাটস, পাশ্চাত্য-দর্শনে আসক্ত... আবার, আগা আবদুর রহমান, নিতান্ত-ই একজন সান্ত্রী, শুধু টুকটাক লিখেন বইলা ‘আগা’ বিষয়টা সংযুক্ত হইছে, এইরম একটা একটা নাম হয়তো ব্যক্তি-বিশেষের প্রবণতার কথা বলে... কিন্তু এইরম নামকরণ এর অভিজ্ঞতা বাংলাভাষা কি আর কোনসময় নিছে?
বলতেছিলাম তাঁর ভাষার কথা, লেখক বা তাঁর চরিত্র যেইভাবে চিন্তা করে, ভাষার গঠন তো সেইভাবেই আসে... তবে ইদানিং ভাষা নিয়া যে বির্তক শুরু হইছে, এইটা দিয়াই আসলে টের পাওয়া যায়, চিন্তার অসহায়ত্ব কোন পর্যায়ে গিয়া পৌঁছাইলে, মানুষ কী বলা হইছে, তার দিকে নজর না দিয়া কীভাবে বলা হইতেছে, তার ওপর গিয়া হুমড়ি খাইয়া পড়ে... এই বির্তক বর্তমান বাংলাভাষায় চিন্তার অসারতার একটা চলমান উদাহারণ। আর এই দেখনদারির বিষয়টা তো আসলে একদিনে ঘটে নাই, ক্রমান্বয়ে আসছে... কিভাবে উচ্চারণটাই মুখ্য হয়া উঠলো, আমি শুনলাম তুমি কীভাবে বললা, কী বললা সেইটা আর মুখ্য না, কারণ তোমার তো বলার কিছুই নাই, ওই উচ্চারণটাই শুধু... যেমন কবিতা-লেখার চাইতে কবিতা-আবৃত্তি অনেকবেশি পপুলারিটি পাইলো... এইটা আলাদাভাবে দেখা গেল হয়তো খুব একটা খারাপ না, কিন্তু এইধরনের বিষয়গুলাই আসলে ট্রেন্ড সেট কইরা দিচ্ছে... তুমি যেইভাবে কথা বলো, বলতে চাও; সেইটারে আটকাইয়া দিয়া আমি তোমার চিন্তারেই কন্ট্রোল কইরা ফেলবো - ভাষার কারাগার (ব্যাকরণ) এ তোমারে ফেলে দিবো!
অন্যদিকে, ভাষা-ই কিন্তু চরিত্রগুলার ডেফিনেশন দিয়া দিতেছে... এই ভিন্নতাগুলি যদি আমরা আটকাইয়া ফেলি, তাইলে মানুষ হিসাবে তাদের চিন্তার ভিন্নতাগুলিরে আমরা কী কইরা প্রমাণ করবো?
আরেকটা জিনিস মনে হইছে, বাংলাদেশের গদ্যের মান যতোটা ম্যাচিউরড, কবিতা আসলে ততোটা হইতে পারে নাই। কারণ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক রে সাইডলাইনে বসাইয়া দিলেও উনাদের প্রভাব আটকাইয়া রাখা যায় নাই, যার ফলে উনাদের পরে বাংলাদেশে গদ্য লিখতে হইলে যে শক্তিটা লাগে সেইটা না থাকলে কোন গদ্যই আর হয় না। কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণের যে ধারাবাহিকতারে জোর কইরা প্রতিষ্ঠিত করা হইতেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে কবিতার কোন পাটাতনই দাঁড়াইতে পারে নাই... হয়তো কবিতার ব্যাপারটাও এইরমই, খুবই এবড়ো-খেবড়ো...
যা-ই হোক, কারাগার এর বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নগুলি খুব স্বাভাবিকভাবেই কাহিনির ভিতর দিয়া উঠে আসছে। ব্যক্তির অনিশ্চিয়তা, তার যোগাযোগ-ক্ষমতা, নৈতিকতা, রাষ্ট্র ও মিডিয়া... রাজনৈতিক নেতারা তো অনেকেই ছিলেন কারাগারে, উনারা কেন এইটা বন্ধ করলেন না? কেন এই চোর-পুলিশ খেলা চলতেই থাকবে? চরিত্রগুলিই এই কথাগুলি বলছে, আলাদা কইরা লেখকরে বলা লাগে নাই; যদিও একটা গোছানো ফর্ম এর ভিতর দিয়াই প্রসঙ্গগুলি আসছে, কোনকিছুই ইমপোজড মনে হয় নাই, মনে হইছে লেখক বিষয়টা ঠিক কইরা রিলেভেন্ট সবকিছুরে একত্রিত করছেন...
আমার পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে যদ্দূর মনে হইছে, সাহিত্যে ‘কারাগার’ মূলত আসছে রাজবন্দীর রোজনামচা অথবা প্রিজন নোট এর মতো, যেইখানে গেলে ‘চিন্তা’ করার সময় পাওয়া যায়, ক্রিয়েটিভ থিকিং আসে... কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলে এইরম রোমান্টিক? সেইটা যে না, তা বলার মতো অন্তত একটা বই পাওয়া গেলো।
আমার বইটা পড়ে ভালো লাগছে আর মনে হইছে ভালোটা স্পষ্ট কইরা বলাটাও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
নোট ১:
‘ভদ্রলোকের কথাটা শুনে মনে মনে পস্তালাম। ঠিক, একদল ফিজিক্যালি ও মেন্টালি আনফিট লোকের মধ্যে আমি পড়ে গেছি। এরা বড্ড বকতে ভালবাসে, কিন্তু কোনো অ্যাকশন পছন্দ করে না।’ (পৃষ্টা - ২৮)
মার্চ ১৩, ২০১০