মুহম্মদ মুহসিন
বইমেলা ২০০৮-এ প্রকাশিত তরুণ কবি জুয়েল মোস্তাফিজের কবিতার বই জুয়ার আসরে কোনো আঙুলই মিথ্যা নয় । প্রকাশের পূর্বেই এটি পড়া হয়ে গিয়েছিল অনেকের। কারণ একটি বিস্তৃত বন্ধুমহলে এর পান্ডুলিপি পাঠ হয়েছিল অনেকটা পাঠচক্রের মত গুরুত্ব দিয়ে। পড়ে আর শুনে তাজ্জব বনে গিয়েছিল শ্রোতা-পাঠকদের তামামটাই। প্রশংসায় প্রশংসায় বাতাস ভারী হয়ে ওঠার উপক্রম। পাণ্ডুলিপি থেকেই একটি বিশাল অংশ ছেপে ফেললেন লোক সম্পাদক শামীমুল হক শামীম। তা-ও আবার এক অভাবনীয় বৈশিষ্ট্যের সাথে। পাণ্ডুলিপির প্রথম পৃষ্ঠায় মুগ্ধ পাঠকরা বিস্ময় আর আনন্দ নিয়ে যেসকল আবেগঋদ্ধ মন্তব্য লিখে দিয়েছিলেন বা লিখে ফেলেছিলেন সেই পৃষ্ঠাটিও অবিকল ফটোকস্পোজ করে ছেপে দিলেন সম্পাদক শামীমুল হক শামীম। কিন্তু যে শিশু গর্ভে সঞ্চারিত হয়ে জন্মের প্রথম প্রহর পর্যন্ত কেড়েছিল ঘরের বাইরের এত আদর এত মনোযোগ, জন্ম থেকে যত দিন গেল সে শিশুই যেন এগুতে থাকলো আপত্তিকর অবহেলা ও অনাদরের দিকে। পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠায়ই যারা প্রকাশ করেছিলেন স্বারিত উচ্ছ্বাস তারাও আশ্চর্যজনকভাবে বইটি প্রকাশের পর মুখে কলমে কোনোভাবেই আর কিছু যেন বলতে চাইলেন না বা বলতে গেলেন না। দিন দিন বিষয়টি এক ব্যাখ্যার অযোগ্য অসামাজিক কার্পণ্য বলে মনে হতে থাকলো। তবে সাথে এ-ও ভাবলাম যে, যাঁদের সাহিত্যবোধ ও বিশ্লেষণী ঐশ্বর্য অতুল তাঁদের কার্পণ্য প্রদর্শনের অধিকার আছে কারণ তাঁদের কথার ঐতিহাসিক রেকর্ড থাকে বলে ভবিষ্যতের অন্তত দুই হাজার বছর দিব্য স্কেলে মেপে তাঁদেরকে কথা বলতে হয়। কিন্তু আমার মত যাদের কথার ঐতিহাসিক তো দূরে থাক সামাজিক গুরুত্বও কম তারা ঝট করে দুই কথা বলে দিলে কথক হিসেবে আমাদেরও বিপত্তি নেই, এবং শ্রোতা হিসেবে অন্যদেরও হয়তো আপত্তি নেই। এই ভরসায়ই তরুণ কবি জুয়েল মোস্তাফিজের বই জুয়ার আসরে কোনো আঙুলই মিথ্যা নয় নেড়ে চেড়ে আরো কয়েকবার পড়া এবং ত্রিকালদর্শী সত্যিকারের সমালোচকদের পাঠদৃষ্টি নিক্ষেপেরও হয়তো অযোগ্য এই লেখা।
বইটির প্রকাশক: অনন্যা। প্রচ্ছদ: আশরাফুল হাসানের “ট্রিম্যান এ্যাণ্ড ওয়াল” অবলম্বনে মাসুদ কবির। পৃষ্ঠা: ৬৪। দাম: একশত টাকা। দামটা একটু বেশিই মনে হয়েছে। বাংলাদেশে কবিতার বই টাকায় বিক্রি হয় এমনটা আমার বিশ্বাস হয় না। কোনোটা বিক্রি হয় শুভেচ্ছায়, কোনোটা শ্রদ্ধায়, কোনোটা নতুন প্রেমে পড়ায় আর কোনোটা নিতান্তই ঠেকায়। সুতরাং টাকাটা কেউই কবিতা বা কবিতার বই কেনার জন্য দেয়না। টাকাটা দেয় শুভেচ্ছার মূল্য হিসেবে কিংবা শ্রদ্ধার মূল্য হিসেবে কিংবা নতুন প্রেমিকার সামনে কাব্যপ্রেমের ভাব নেয়ার মূল্য হিসেবে। আর এর কোনোটা না হলে শুধু একারণে যে ক্রেতা নেহায়েত ঠেকায় পড়েছে টাকাটা না দিয়ে উপায় নেই তাই। এমন বাংলাদেশে একজন তরুণ কবির প্রথম কবিতার বইয়ের দাম রাখা হবে একশত টাকা, বিষয়টা বেশ ডেয়ারিং বলেই আমার মনে হয়। জুয়েল মোস্তাফিজ অথবা তার প্রকাশক সেই ডেয়ারিং কাজটিই করেছেন। তবে জুয়েলের এই ডেয়ারিং সাহস শুধু বইয়ের দামেই নয়, এর সারা গায়ে। (পাঠক, “ডেয়ারিং সাহস” শব্দবন্ধটি আমার মায়ের। সুতরাং ভুল হলে আমার মায়ের দোষ।)
জুয়েল মোস্তাফিজের এই সাহস তার কবিতার নির্মাণে, অনুভূতির রসায়নে, শব্দের উচ্চারণে, চিত্রকল্পের আয়োজনে এবং সর্বোপরি কবিতার অঙ্গসজ্জায় বা পৃষ্ঠাসজ্জায় প্রায় সর্বত্র। জুয়েল মোস্তাফিজের কবিতাগুলো একাধিক বৈশিষ্ট্যেই এক বেপরোয়া নির্মাণ। তাঁর নির্মাণের তাত্ত্বিক ভিত্তিটি পরাবাস্তবতা। নি:সন্দেহে বাংলা কবিতায় তাত্ত্বিক ভিত্তি আকারে পরাবাস্তবতা নতুন কিছু নয়। কিন্তু জুয়েল মোস্তাফিজের কাছে এটি শুধু তাত্ত্বিক ভিত্তি নয়, এটি তাঁর কবিতার কাব্যচিন্তা, কবিতার বাক্য বিন্যাস এবং সর্বোপরি তাঁর সকল অনুভূতির প্রকাশক তাবৎ চিত্রকল্পের শক্ত ও সুগঠিত ভিত্তি। জুয়েল মোস্তাফিজ অবশ্য এই তত্ত্বের মসৃণ ইউরোপীয় মোজাইকটি ভেঙ্গে দিয়ে এর উপরে তুলতে প্রয়াস পেয়েছেন প্রকৃত বাংলা চৌচালা। পরাবাস্তবতার ইউরোপীয় মোজাইকটি না ভাঙতে পারা পর্যন্ত এই ভিতের উপরে সুবিধামত দাঁড়াচ্ছিল না বাঙ্গালী কায়দার গরাণের খুঁটির আর তালপাতার ছাউনির ঢ্যাঙ্গা চৌচালা। সুধীন্দ্রনাথ বিষ্ণু প্রমুখ যাঁরা বাংলা কবিতায় পরাবাস্তবতার প্রথম স্থাপত্যের নির্মাতা তাঁরাও ইহার ইউরোপীয় ভিতের উপরেই তাঁদের দেয়াল-খুঁটি স্থাপন করেছিলেন। ভিতটিকেই যে ভেঙ্গেচুরে বাঙ্গালীকরণ করে নিতে হবে এই তাগিদ তাঁরা অনুভব করেন নি। এমনকি কবিকুলগৌরব জীবনানন্দ দাশও পরাবাস্তবতাকে কবিতার নেহায়েত অঙ্গসজ্জার ঊর্ধে খুব একটা স্থান দিয়েছেন বলে মনে হয় না। সেই অঙ্গসজ্জার অবস্থানে থেকে এই পরাবাস্তবতার বিষয়টি পুরো কবিতার ভিত রচনার চাইতে বরং চিত্রকল্পের চমক ও চমৎকারিত্বের প্রতিই বেশি নিবদ্ধ ও নিবিষ্ট ছিল।
জুয়েল মোস্তাফিজের েেত্র চিত্রটি সম্পূর্ণ আলাদা। যেমনটা কেবল হলো, জুয়েল মোস্তাফিজের জুয়ার আসরে কোনো আঙুলই মিথ্যা নয় কাব্যগ্রস্থে পরাবাস্ততা এর পূর্ণ নির্মাণ ভিত্তি। এখানে কাব্যচিন্তাগুলো কবিমনে এমন প্রচণ্ডতায় আলোড়িত যে সে চিন্তাসমূহ ও তাদের সাংসর্গিক বস্তুনিচয় তাদের সামগ্রিক স্বাভাবিক দৈনন্দিন চেহারা স্থায়ীভাবে হারিয়ে ফেলেছে। কবির অভিজ্ঞতাসমূহ তাঁর মানসরাজ্যে এমন রণ ঘটিয়েছে যে তীব্র দহনে ও আঘাতে তাঁর পূর্ণ মানস আধারটিরই আবর্তন ও বিবর্তন ঘটেছে বিভিন্ন ধারায় ও শক্তিতে। এই আবর্তিত ও বিবর্তিত মানসআধারের অনুভব বাস্তবতাও স্বাভাবিকভাবেই বহুমুখী ধারায় প্রসারিত ও বিবর্তিত। ইহাই পরাবাস্তব অনুভবতা। পরাবাস্তব অনুভবের এই প্রচণ্ডতাকে ধারণ করতে কবিতার পূর্ণ চেহারাটিই পরাবাস্তব হয়ে ওঠে, কারণ শুধু পরাবাস্তব চিত্রকল্প কিংবা শুধু বাক্যের পরাবাস্তব বিশৃঙ্খল বুনন এর পূর্ণ প্রচণ্ডতাকে ধারণের শক্তি রাখে না। জুয়ার আসরে কোনো আঙুলই মিথ্যা নয় কাব্যগ্রস্থে প্রায় সমুদয় কবিতাই এই বক্তব্যের সত্যতা ধারণ করে। ফলত যে কোনো একটি কবিতা থেকেই উদাহরণ উপস্থাপন সম্ভব।
ধরা যাক কবিতা সংখ্যাক্রম ঊনচল্লিশ।
খরগোশের ইতিহাস লেখার আগে আমরা আরো একবার সূর্যের
কাছে যেতে পারি। সেখানে যদি খুরের চিহ্ন না থাকে তবে
কখনোই বলবো না যে, তোমার পরিত্যক্ত খোপার ভিতরেই
খরগোশের জন্ম। খরগোশের পায়ের দিকটা দেখলেই সূর্যের সাথে
অন্য পৃথিবীর বিরোধ বাড়ে। তাইতো অধিকাংশ বৈঠকে কাঁচা কাঁচা
খরগোশ পাওয়া যায়। আমি কখনোই বলবো না যে, কাঁচা কাঁচা
খরগোশগুলো তোমাকে চিনিয়েছিল অন্ধকার। খরগোশের
উল্টোচোখে হঠাৎ মারা গ্যালো পথের বানিয়া। পথের বানিয়া মারা
গেলে অন্ধকার বেয়াড়া হয়ে যায়, খরগোশের ইতিহাস লেখার
আগে আমরা আরো একবার তোমার ইয়াবা অন্তর খুঁজে দেখতে
পারি, লাঙ্গলের ফলার মত সেখানে কোনো পাপ আছে কি না?
খরগোশের পিঠে খুঁজেছি তোমার পাপ। সকল পাপ তাপ হয়েছে
খরগোশের ভেতর। তাহলে কি তাবিজের ওপর ভর করলেই
চলবে? তাহলে কি ডাকতে হবে বানিয়া বন্ধুর মৃত্যু? সেই মৃত্যুর
ওপর কত জ্বর চড়েছিল কে জানে। জান নাকি তুমি কখন কখন
খরগোশের মাংসে সুবর্ণ নেমে আসে? অবিশ্বাসের পথে তুমিই
ভরসা, তোমার ছায়ার ভেতর দেখেছি মরা মরা খরগোশ।
কবিতাটির কাব্যচিন্তাটুকু যে বাক্যসমূহে এবং বাক্যসমূহের মাঝে বিধৃত চিত্র-পরম্পরায় গ্রথিত বিচ্ছিন্ন চিত্ররূপে তাদেরকে বিশ্লিষ্ট করলে এর পরাবাস্তব নির্মাণটি সাধারণ দৃষ্টিতে আরেকটুখানিক স্পষ্টতর হতে পারে। প্রথম চিত্র: খরগোশের ইতিহাস, দ্বিতীয় চিত্র: সূর্যের গায়ে খরগোশের খুরের দাগ, তৃতীয় চিত্র: একটি পরিত্যক্ত খোপা, চতুর্থ চিত্র: সূর্যের সাথে পৃথিবীর বিরোধ, পঞ্চম চিত্র: খরগোশের চেনানো বেয়াড়া অন্ধকার, ষষ্ঠ চিত্র: খরগোশের রোষানলে (উল্টোচোখে) মৃত পথের বানিয়া, সপ্তম চিত্র: খোপা পরিত্যাগী রমণীর ইয়াবা অন্তর এবং সর্বশেষ চিত্র: সেই ইয়াবা অন্তরে লাঙ্গলের ফলার মত হৃদয়ের দেয়ালবিদারী পাপ। যে কয়টি চিত্র প্রায় সেই কয়টিই বাক্য। চিত্রে চিত্রে সংযোগ বুননের আলাদা বাক্যের আয়োজন নেই। আবার চিত্রগুলোর মাঝে পারস্পরিক কোনো দৃশ্যমান আন্তসংযোগ সূত্রও নেই। স্পষ্ট দূরত্বজ্ঞাপক বিশৃঙ্খল এবং খাপছাড়া এক বিন্যাস। পরাবাস্তবতার একবোরে পুঁথিগত সংজ্ঞার পূর্ণমাত্রিক উদাহরণ। জীবনানন্দ প্রমুখ পরাবাস্তবতার সূচনাকারীগণ কবিতার জমিনটি এভাবে ঠাসবুনন চিত্রের পরাবাস্তব বিশৃঙ্খলা দ্বারা নির্মাণ করে নেন নি কিংবা নির্মাণের সাহস করেন নি। হয়তো ভয় ছিল বাংলা কবিতার দীর্ঘ ঐতিহ্যের ইন্দ্রিয় আমোদিত সুষমাটুকু ুণœ হবে। ফলত তাঁদের কবিতার জমিন বা ভিতটি পরাবাস্তবতায় নির্মিত নয়, যেমনটা নির্মিত জুয়েল মোস্তাফিজের জুয়ার আসরে কোনো আঙুলই মিথ্যা নয় কাব্যগ্রস্থের উপরোক্ত উদ্ধৃতিসদৃশ সমুদয় কবিতার জমিন বা ভিত।
ল্যণীয়, জুয়েল মোস্তাফিজের কবিতার এই পরাবাস্তব ভিত্তির টেকনোলজিটুকু ইউরোপীয় হলেও, ইটবালিটুকু আমাদের অর্থাৎ বাঙ্গালীর। চিত্রগুলোর একটিও এমন কোনো বস্তুগত কিংবা অবস্তুগত উপাদান বহন করে না যা ইউরোপীয় উত্তরাধিকারের প্রত্য বা অপ্রত্য ফসল। ধীগত বা অধিগত (Epistemological or Ontological) কোনো স্তরেই সম্ভবত এমন কোনো ঋণ নেই। আটটি চিত্রের প্রতিটিই বস্তুগতভাবে বাঙ্গালীর ঘরের ও চলার পথের বস্তু। চিত্রসমূহের সন্নিবেশন সংশ্লিষ্ট সাংসর্গিক বোধটুকুও বাঙ্গালীর বোধ এবং বাঙ্গালীর জীবনাচার থেকে জাত ও চয়িত। লাঙ্গলের ফলার মত হৃদয়ের দেয়ালবিদারী পাপ কিংবা চাঁদের গায়ে বুড়ির দাগের মত সূর্যের গায়ে খরগোশের খুরের দাগ- এ সকল চিত্রই বাঙ্গালীর সনাতন বোধ ও কৃষ্টি জাত। সুতরাং এ কথা বলা বৈধ যে জুয়েল মোস্তাফিজ তাঁর কাঁচা তবে সাহসী হাতে পরাবাস্তবতা নামের ইউরোপীয় নির্মাণভিতটিকে ভেঙ্গেচুরে বাঙ্গালী মোজাইকে রূপদানের প্রয়াস পেয়েছেন।
পরবর্তী জিজ্ঞাসা, পরাবাস্তবের এই শিলান্যস্ত ভিত্তিতে যে নির্মাণ তিনি সম্পন্ন করলেন তার গড়ন ও গঠন শেষপর্যন্ত কতখানি বিশুদ্ধতা ও স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত পরাবাস্তবতা ধারণ ও বহন করতে পারলো। তবে এ কথা বলা-ই বোধ হয় বাহুল্য যে যার ভিত্তিই এমন মজবুতভাবে একটি নির্দিষ্ট চরিত্রের তার অবশিষ্ট নির্মাণটুকুও উক্ত চরিত্রকে বিশুদ্ধভাবে ধারণ করবে এটাই স্বাভাবিক। জুয়েল মোস্তাফিজের চিত্রকল্পগুলো যে অধিকাংশ েেত্রই একেবারে রাসায়নিক উপাদানগতভাবে খাটি পরাবাস্তব চরিত্রের তা পাঠকমাত্রেই ল্য করবেন বলে আমার বিশ্বাস। খানিক আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে আমাদের পূর্ববর্তী খ্যাতনামা যশস্বী কবিরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেরই তাঁদের পরাবাস্তব চিত্রগুলোকে শুধু পরাবাস্তবতার পুষ্টিতে লালন করেন নি। তাঁরা সেগুলোকে কাব্যিক কোমলতায় অভিষিক্ত রাখতে পুষ্টি জুগিয়েছেন ইন্দ্রিয়-আমোদি (sensuous) উপাদানে এবং ধ্বনিগত ব্যঞ্জনায়। এছাড়াও ধারাবাহিকভাবে পরাবাস্তব চিত্র বাঙ্গালী মস্তিষ্কপটে পৌনপুনিক প্রপেনে একধরণের নিউরনিক বেদনা সৃষ্টি করতে পারে বলে হয়তো তাঁদের আশঙ্কা ছিল। আমার বিশ্বাস কবি জুয়েল মোস্তাফিজের এমন আশঙ্কা জেগে থাকলেও একটি বিপরীত বিশ্বাস তাঁর ভিতরে ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। তাঁর মনে হয়েছে তাঁর রণবাহী অনুভব যন্ত্রে বিকৃত ও বিশৃঙ্খল বাস্তবের বস্তু ও অভিজ্ঞতার যে দৃশ্যমালা সদা প্রবহমান তাহা কোনো গীতল ও ইন্দ্রিয়-আমোদিত চিত্রকল্পমালায় প্রকাশ সম্ভব নয়। তাই পরাবাস্তব চিত্রকল্পমালার মাঝে রিলিফ বা মানসিক প্রশান্তি সাধন উদ্দেশ্যে আমাদের কাব্য ঐতিহ্যের গীতল ও ইন্দ্রিয়-আমোদিত চিত্রকল্পের বুনন জাতীয় কাজটি থেকে নিজেকে সচেতনভাবে বিরত রেখেছেন কবি জুয়েল মোস্তাফিজ। ফলস্বরূপ কবিতার সম্পূর্ণ নির্মাণটিই দাঁড়িয়েছে বাংলা কবিতায় এ যাবৎ কালে আমার দেখা সবার থেকে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত এক বিশুদ্ধ ও নিরঙ্কুশ পরাবাস্তবের নির্মাণ।
কবিতার পূর্ণ কাঠামো ও নির্মাণ জুড়ে পরাবাস্তবের এই বিশুদ্ধতা ও নিরঙ্কুশতার মাত্রা কি কবিতাটির বা কবিতাসমূহের মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের মাত্রা জ্ঞাপক? তা কিন্তু আমরা একদমই বলতে পারি না। পরাবাস্তবের এই পূর্ণ নির্মিতি ধারাবাহিকভাবে পরাবাস্তব চিত্রের পৌনপুনিক প্রপেন দ্বারা বাঙ্গালী মস্তিষ্কপটে কতখানি নিউরনিক বেদনা সৃষ্টি করবে কিংবা আদৌ কোনো বেদনা সৃষ্টি করবে কিনা; এবং মস্তিষ্ককোষের সেই বেদনা বাঙ্গালী পাঠকের জন্য কতখানি নান্দনিক বিমোক্ষণ (catharsis) ঘটাবে কিংবা নান্দনিক বিমোণের পরিবর্তে কতখানি বিরক্তি ঘটাবে তাহা শুধু ভবিতব্যই জানে। এই মুহূর্তে আমি শুধু নিশ্চিতভাবে এইটুকুই জানি বলে মনে হয় যে যাহা করেন নি কবিকুলশিরোমণি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যাহা করেন নি কবিকুলগৌরব জীবনানন্দ দাশ তাহা করেছেন কিংবা ঘটনাক্রমে করে ফেলেছেন মাত্র খোকা কবি জুয়েল মোস্তাফিজ। জুয়েল মোস্তাফিজের এই “ডেয়ারিং সাহস”- এর জন্যই আমি তাঁর জয়ধ্বনি গাইতে আগ্রহী। জয়তু! জয়তু!! কবি জুয়েল মোস্তাফিজ।
প্রকাশ লোক ১৩ সংখ্যা ফ্রেবুয়ারী ২০১০
জুয়েল মোস্তাফিজের জুয়ার আসরে কোনো আঙুলই মিথ্যা নয় ডাউনলোড করুন।